ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একজন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী। বর্তমানে ঢাকা শহরের মিরপুরস্থ ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে’র গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং নৈতিক চেতনার স্ফুরণ ঘটানো প্রজ্ঞানন্দের শিক্ষা-ভাবনার মৌলিক দিক। খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে তাঁর শিক্ষা-জীবনের সূচনা। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে পালিতে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। নিরহংকার, সহজ, সরল সহৃদয় এই ব্যক্তির বাল্যকাল ছিল দারিদ্র্যের করালগ্রাসে জর্জরিত। ১৭ বছর বয়স থেকে পরিবার বিচ্ছিন্ন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো নিজের সংযম ও কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছেন। মঙ্গল-চিন্তায় উজ্জীবিত হয়েছেন শিক্ষা বিস্তারে। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর নিন্মোক্তটি সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন।
মিল্টন বিশ্বাস: একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে আপনার সংগ্রামের কথা বলুন।
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: একজন অনাথ শিশু হিসেবে আমার শৈশব শুরু হয়েছিল। সম্ভবত বছর দেড়েক বয়সে আমি পিতৃহারা হই। বাবার পরলোকগমনের বছরে আমি না-কি গড়গড়িয়ে হাঁটতে পারি। আমার সঠিক জন্মক্ষণ ও তারিখ লিখে-রাখার প্রয়োজনীয়তা বা সংস্কৃতি চালু ছিল না বলে অনুমেয়। পাসপোর্ট ও সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেটের সনদপত্র অনুসারে আমার জন্মতারিখ ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু আমার সত্যিকার জন্মতারিখ হলো ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ। চার ভাইয়ের মধ্যে আমি সকলের ছোট। বড় তিন ভাই স্কুলের বারান্দায় হাঁটার অবকাশ না পেলেও মহাকাব্য মহাভারত ও রামায়ণ পড়ার তাগিদে স্ব-উদ্যোগে বাড়িতে বাল্যশিক্ষা ও ধারাপাত পড়ে তাঁদের নাম লিখে দস্তখত করতে পারে। আমারও লেখাপড়ার হাতেখড়ি বাড়িতে বাল্যশিক্ষা ও ধারাপাতের বদন্যতায়। আমি বাড়িতে থাকাকালীন বাল্যশিক্ষাটি আগাগোড়া আত্মস্থ ও ধারাপাতের বারো নামতা পর্যন্ত মুখস্থ বলতে পারতাম।
বাবুছড়া প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির সময় আমার বয়স সাত বছরের কাছাকাছি হতে পারে। জ্ঞান হওয়া অবধি অভাব-অনটন, দু:খ-দারিদ্র্য কাকে বলে- তা আমি হাড়ে-হাড়ে উপলব্ধি করেছিলাম। কারণ, গোটা বছরের ছয়মাস অভুক্ত, অর্ধভুক্ত অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল। বনের আলু, যাগুভাত, শুধুমাত্র লবণ দিয়ে সিদ্ধ করা ওল কচু খেয়ে আমাকে বাবুছড়া প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হয়েছিল। বলা যায়, শৈশবাবস্থায় আমার পড়ালেখার বড় চ্যালেঞ্জটি ছিল পারিবারিক অভাব-অনটন। পড়ালেখার প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল বিধায় অভুক্ত, অর্ধভুক্ত অবস্থায়ও প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কঠিন ও কঠোর বাস্তবতার মধ্য দিয়ে আমি আমার শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখতে সক্ষম হই। তখনও পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সরকারি বিধান চালু ছিল। আমি পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিই। কিন্তু বৃত্তি লাভ করা সম্ভব হয় নি। অর্থাভাবে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পর আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল। আমি পাশর্^বর্তী একটি গ্রামের গোয়াল ঘরে আমার থেকে বয়সে বড় প্রাথমিক পর্যায়ের পঁয়তাল্লিশ জন ছাত্র-ছাত্রীকে পড়াতে শুরু করি। আমাকে মাসিক বেতন হিসেবে দিত পঁচিশ টাকা। উদ্দেশ্য, শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে আমার পড়াশোনা চালিয়ে-যাওয়া। কিন্তু যৌবনে পদার্পণোদ্যোত কিশোরের অপরিপক্ক ও বেহিসেবী জীবনাচারের কারণে দশমাস শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও দশটি পয়সা জমা করা আমার দ্বারা সম্ভব হয় নি। আমার গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই ছিল জুমচাষি। আমার বড় ভাইরা জুম চাষ করতেন। স্কুল ছুটি থাকলে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তাদের সাথে জুমের মোনঘরে থাকতে যেতাম। তখন আমার মা তাদের সাথে থাকতেন বিধায় মাকে দেখতে যাওয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব মনে করতাম। ভাদ্র মাসে জুমে ধান পাকতো। এই ভাদ্র মাসেই ৩৩ নং নুনচড়ি মৌজার হেডম্যান বাবু পিযুষ কান্তি চাকমা জুমের খাজনা আদায়ের জন্য জুমিয়াদের বাড়িতে-বাড়িতে গিয়ে আতিথ্য গ্রহণ করতেন ও খাজনা আদায় করতেন। তিনি যে বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করতেন- সেই বাড়িতে একটি উৎসবের আবহ সৃষ্টি হতো। সকল জুম চাষি সেই বাড়িতে এসে জুমের খাজনা জমা দিয়ে যেত। এমনতরো একটি উৎসবের দিনে আমি বাবু পিযুষ কান্তি চাকমার নজর কাড়তে সক্ষম হই। তিনি আমার মুক্তার মতো হস্তাক্ষর, সুর সহযোগে ও শুদ্ধ উচ্চারণে রামায়ণ পাঠের কারিশমা দেখে আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় বাবুছড়া জুনিয়র হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। যেহেতু আমার এক বছরের Break of Study ছিল। তদুপরি লিখিত ভর্তি পরীক্ষায় আমার যোগ্যতার স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করে প্রধান শিক্ষক মহোদয় আমাকে সরাসরি ৭ম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দিলেন। বাবু পিযুষ কান্তি চাকমা তখন দুটি মৌজার হেডম্যান ছিলেন। প্রতি সপ্তাহের বুধবার বাবুছড়া বাজারে হাট বসতো। বাজারটি লোকে লোকারণ্য হতো। সেদিন তিনি দূর-দূর থেকে সওদা করতে আসা জুমিয়া প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। খাজনা আদায়ের কাজে মাঝে-মাঝে আমি তাঁকে সাহায্য করতাম। বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটা ছাড়া আমার আর তেমন কোনো কাজ ছিল না বিধায় সারাদিন পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করতাম। সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় আমি সকল ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে শীর্ষস্থান অর্জন করতে সক্ষম হলাম। এতে আমার মাসিক ভিত্তিতে প্রদেয় স্কুলের টিউশন ফি মওকুফ হলো। অষ্টম শ্রেণিতেও শীর্ষস্থানটি আমার অক্ষুন্ন থাকলো। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পাশ করার পর বাবু পিযুষ কান্তি চাকমা আর আমাকে পড়াতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। কারণ, মাইনী উপত্যকার একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয় দিঘীনালা হাইস্কুলটি বাবুছড়া থেকে কমপক্ষে বারো কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। আমি আবারও শিক্ষকতা পেশায় অবতীর্ণ হলাম। বেতন নির্ধারিত হলো ৩৫ টাকা। আবারও দীর্ঘ দশ মাস শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে দশ পয়সাও সঞ্চয় করতে না পারার এক পর্যায়ে আমি কাট্টন্যাদের সাথে বাঁশ সংগ্রহের জন্য কাচালং উপত্যকার গহিনে অরণ্য লালু-কালুতে চলে গেলাম। কাট্টন্যারা আমাকে তিন হাজার কর্তিত বাঁশ দান করেছিলেন। এ বাঁশগুলো আমাকে কাঁধে করে লালু-কালু ছড়ার পাড়ে নিয়ে আসতে আড়াই মাস লেগে গিয়েছিল। বাঁশের ভেলা তৈরির বেলায় কাট্টন্যারা আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেন। পাক্কা তিন মাস পর আমি কাট্টন্যাদের সাথে তিন হাজার বাঁশের ভেলা মারিশ্যার সিজকমুখ বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসতে সক্ষম হলাম। তখন এক হাজার বাঁশের বাজার মূল্য ছিল পাঁচশ টাকা। আমি তিন সহ¯্র বাঁশ বিক্রয় করে নগদ পনেরোশ টাকা হাতে পেলাম। তার পরদিনই কাট্টন্যাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাঙ্গামাটিতে নবম শ্রেণির পাঠ্যবই কিনতে চলে গেলাম। আমার কায়িক পরিশ্রমের টাকার দ্বারা নবম শ্রেণির বই সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, স্কুলের ভর্তি ফি মাসিক টিউশন ব্যয় বহন করার কোনো উপায় না দেখে আমি বাধ্য হয়ে বোয়ালখালীস্থ ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে’ একজন অনাথ ছাত্র হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিই। শুরু হয় আমার আশ্রমিক জীবন। গুরু সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে’র প্রতিষ্ঠাতা আমার প্রতি পরিপূর্ণ সদয় ছিলেন। তাঁর উপাধ্যায়ত্বে শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা নেয়ার পর পরই তিনি আমাকে দিঘীনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দিলেন। দিঘীনালা হাইস্কুলে নবম শ্রেনিতে ভর্তি হওয়ার পর আমরা শিক্ষানবিশি রংবস্ত্রধারী শ্রামণের আরেকটি কঠিন ও কঠোর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলাম। আমরা সর্বমোট সতেরো জন রংবস্ত্রধারী শ্রামণের ও আঠারো জন বালক বোয়ালখালী দশবল বৌদ্ধ রাজ বিহারকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথাশ্রম’ থেকে দীর্ঘ সাড়ে চার কিলোমিটার মেঠো পথ হেঁটে দিঘীনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে যেতাম। রংবস্ত্রধারীদের স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করার ব্যাপারে তথাকার একজন বৌদ্ধ শ্রমণ সাধনানন্দ ভিক্ষু ও তাঁর অনুসারীদের সাংঘাতিক অ্যালার্জি ছিল। আমরা যারা রংবস্ত্র ধারণ করে শ্রামণের অবস্থায় নিবিড় পড়ালেখায় নিরত ছিলাম- আমাদের ওপর ওই বৌদ্ধ শ্রামণ ও তাঁর অনুসারীদের বিরূপ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমাদের ব্যাপারে নানাবিধ কুৎসা রটনা, দুঃশীল হিসেবে অভিযুক্ত করা, বৈকালিক ভোজনের অপবাদ দেয়া, আমাদেরকে যাঁরা স্নেহসিক্ত ও সমর্থনের বাতাবরণে মূল্যায়ন করেন- তাঁদেরকে নরকের ভয় দেখানো প্রভৃতি ছিল তাদের নিত্য-নৈমিত্তিক প্রচারণার অনুষঙ্গ। তাঁদের দ্বারা আয়োজিত প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হাজার-হাজার মানুষের জনসমুদ্রে আমাদের নিন্দাবাদ বিঘোষিত করাই ছিল ওই শ্রামণ মহোদয়ের ধ্যানজ্ঞান ও লালিত স্বপ্ন-সাধ। তারই ধারাবাহিকতায় মাইনী উপত্যকার কতিপয় মধ্যবিত্ত ধনিক শ্রেণি আমার পরমারাধ্য গুরু ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো মহোদয়কে নি¤œরূপ বিশেষণে বিশেষায়িত করে তাঁর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করার প্রয়াস পান: ‘‘শালার জ্ঞানশ্রী এই মাইনী এলাকায় কী শুরু করেছে! যত্ত সব ‘নেয়্যা নাধংসা, অনাথ, অসহায়, ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র ছাত্র একত্র করে পড়ালেখা করানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।’ এসব ছাত্র বিএ, এমএ পাশ করে আমাদের মাথার উপর স্টিম রোলার চালাবে, আমাদের মাথার ওপর ‘বেরমা ও ছিদোল পুড়ে খাবে। অতএব শালার জ্ঞানশ্রীর এরূপ হীন, ঘৃণ্য ও নারকীয় কাজ থেকে জোর করে হলেও তাঁকে বিরত রাখা উচিত। তাই আসুন, আমরা সকলে তার এরূপ হীন ঘৃণ্য ও নারকীয় কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই।’ এরূপ জঘন্য ও হীন মানসিকতাসম্পন্ন প্রচারণা আমাদের নিবিড় ও নিরবচ্ছিন্ন পড়ালেখার ব্যাপারে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে উদ্ভূত হয়। তবে আমাদেরকে , আমাদের পরম পূজ্য গুরু জ্ঞানশ্রী মহাথেরো মহোদয়ের শিক্ষাবিস্তারমূলক অনন্যসাধারণ কাজের আন্তরিক সহযোগিতাদানকারী দূরদর্শী-বিদগ্ধজনের সংখ্যাও কম ছিল না। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আনুমানিক সতেরো বছর বয়সে শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা নিয়ে অনাথাশ্রমের অর্থায়নে কঠিন ও কঠোর আশ্রমিক জীবনের নানাবিধ প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, অভাব-অনটনের নৈমিত্তিক জ¦ালা-যন্ত্রণা বুকে ধারণ করে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আমি দ্বিতীয় বিভাগে সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। ভবিষ্যতে আমার পড়ালেখার পথ আরো সুগম হবে ভেবে সেই বছর পবিত্র বুদ্ধ পূর্ণিমা গতে অষ্টমী তিথিতে ভিক্ষু হিসেবে Higher Ordination গ্রহণ করি। আমার গুরু পরমারাধ্য জ্ঞানশ্রী মহাথেরো দুবছর বিনা বেতনে পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে শ্রম দান করলে দুবছর পর আমাকে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করবেন মর্মে শর্তারোপ করলেন। তাঁর শর্ত উপেক্ষা করে পড়ালেখা অব্যাহত রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই আমি বাধ্য হয়ে দুবছরের Break of study মাথায় নিয়ে ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে’ স্বেচ্ছাশ্রম দান করতে শুরু করলাম। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে আমার দুবছরের শ্রমদানের ব্যাপ্তিকাল পূর্ণ হয়। গুরু আমাকে প্রখ্যাত পন্ডিত, বহুগ্রন্থ প্রণেতা, প্রথিতযশা সংঘমনীষা পরমারাধ্য শ্রীমৎ শীলালঙ্কার মহাস্থবির মহোদয়ের পুণ্যতীর্থ মির্জাপুর শান্তিধাম বিহারে তাঁর একান্ত সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য পাঠালেন। সেখানে অবস্থানকালীন আমি নাজিরহাট ডিগ্রী কলেজে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। আমি নাজিরহাট ডিগ্রী কলেজে ১ম বর্ষ উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিই ও পাশ করি। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে জোবরা বড়–য়া গ্রামের ‘জোবরা সুগত বিহারে’র অধ্যক্ষ পদে ব্রতী হয়ে সেখানে গমন করি। জোবরা গ্রাম থেকে নাজিরহাট ডিগ্রী কলেজের দূরত্ব বেশি হওয়ায় নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকা সম্ভব হচ্ছিল না বিধায় স্থানীয় হাটহাজারী কলেজে দ্বিতীয় বর্ষ উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হই। সেই কলেজে পড়ালেখায় নিরত থাকাকালীন ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আমলে একবার ও বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলাদেশ সরকারের আমলে দ্বিতীয়বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হই। জোবরা বড়–য়া গ্রামের ‘জোবরা সুগত বিহারে’ অধ্যক্ষ হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন নতুন আরেকটি চ্যালেঞ্জের মখোমুখি হই। ‘জোবরা সুগত বিহারে’ অধ্যক্ষ হিসেবে ব্রতী হওয়ার সময় আমার বয়স ছিল চব্বিশ বছর। সচরাচর স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া যুবক ভিক্ষুদেরকে বৌদ্ধ জনগণ আংশিক অবিশ্বাসের চোখে দেখে। কারণ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরাজিত হওয়ার মোক্ষম অস্ত্র হলো কামিনী আর কাঞ্চন। অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষুর পূর্ব ইতিহাস কামিনী-কাঞ্চনের কারণে মসীলিপ্ত হয়েছে। আমিও ২৪ বছরের একজন টগবগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বৌদ্ধ ভিক্ষু। কামিনী-কাঞ্চনের কারণে যে কোনো সময় আমার মসীলিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিধায় জোবরা গ্রামের বড়ুয়া বৌদ্ধরা দীর্ঘ তিন বছর আমাকে তীক্ষ্ম নজরে রেখে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, যা আমার স্বাভাবিক অধ্যয়ন-স্পৃহাকে আংশিক ব্যাহত ও বেদনাদীর্ণ করেছিল। মোদ্দা কথায় পড়ালেখার প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত আমার নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়নের সময় দুর্লঙ্ঘ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল সাংঘাতিক আর্থিক দৈন্যদশা, অভাব-অনটন, পাঠ্যবই সংগ্রহে অপারগতা, মুখরোচক খাদ্যসামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে শারীরিক জীর্ণদশা, বৌদ্ধ ভিক্ষু বিধায় ক্লাসের বন্ধু-বান্ধবীদের কাছ থেকে সদা-সর্বদা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার অসহনীয় তাগিদ ও বাধ্যবাধকতা আমাকে অনেকাংশে অন্তর্মুখী ও লাজুক এবং ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এরূপ দ্বিধান্বিত মন-মানসিকতার আবর্তে নিপতিত করেছিল। সাধনানন্দ ভিক্ষু (বনভিক্ষু) ও তার অনুসারীদের এবং কতিপয় বুর্জোয়া মানসিকতাসম্পন্ন মধ্যবিত্ত ধনগর্বী ধনিক শ্রেণির ঘৃণ্য, হীন, মিথ্যায় পরিপূর্ণ নিন্দাবাদ প্রচার ও কুৎসা রটনার কারণে তাদের ওইসব অপবাদকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে নিজেকে ন্যূনপক্ষে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের আত্ম-নিবেদিত অঙ্গীকারকে বাস্তব রূপ দেয়ার এষণায় আমি নিজেকে নিবিড় পড়ালেখায় চিনে জোঁকের মতো আসক্ত করে রেখেছিলাম। এটিই হলো আমার শিক্ষার প্রতি অনুরাগের প্রাথমিক পর্যায়ের সংগ্রাম। সংগ্রামের কতটুকু বিজয়ী-তা এখনো আমার অজানা। তবে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ সম্মানসহ এমএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করতে সক্ষম হই এবং অঙ্গীকার পূরণ করার সাফল্যে কৃতকার্য হই।
মিল্টন বিশ্বাস: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করার জন্য আপনাকে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে – সেগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে কি একই রকম রয়েছে? কী পরিস্থিতি বিরাজ করছে?
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: আমি অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র আদিবাসী চাকমা জনগোষ্ঠীর সন্তান। কোনো বৌদ্ধকুল ত্যাগ করে অনাগরিক হিসেবে রংবস্ত্র ধারণ করে শ্রামণ অথবা উচ্চতর ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষা নিলে তার কোনো জাতি-পরিচয় বহন করার অবকাশ থাকে না। বুদ্ধ বলেছেন, ‘‘জন্মসূত্রে কেউ চ-াল, ব্রাক্ষণ হয় না, কর্মসূত্রেই মানুষ চ-াল, ব্রাক্ষণ আখ্যাপ্রাপ্ত হয়।’’ বৌদ্ধকুলে জন্মগ্রহণ করে কেউ যদি পঞ্চশীল প্রতিপালন না করে , পঞ্চবাণিজ্যে আসক্ত হয় ও জীবিকা নির্বাহ করে, হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে কেউ যদি অহিংসার বাতাবরণকে ধ্বংস করে সে জন্মসূত্রে বৌদ্ধকুলে জন্মগ্রহণ করলেও বস্তুত সে বৌদ্ধ নয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও পারতপক্ষে বুদ্ধের এ দিক-নির্দেশনা অনুসরণ করার তৎপরতা ও তাগিদ অনুভব করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির বেলায় সংখ্যাগুরু বাঙালি জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনার হাল-হকিকত আমার জানা ছিল না। কিন্তু আমি একজন অনাগরিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হলেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অনাথ, অসহায় ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র সন্তান-সন্ততিদেরকে আহ্বান করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাকের ডগায় পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম, মোনঘর শিশু সদন, বনফুল শিশু সদন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে গিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতির আধিপত্যবাদী চ্যালেঞ্জ, সাধনানন্দ ভিক্ষু ও তার অনুসারীদের জঘন্য কুরুচিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর অপবাদ সম্বলিত প্রচার-প্রচারণার চ্যালেঞ্জ অনাথ, অসহায়, ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র সন্তান-সন্ততিদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারে পরাক্সমুখ মধ্যবিত্ত ধনিক শ্রেণির অসহযোগিতার পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির তৎপরতা আমাকে সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। চাকমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একজন সন্তান হলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওইসব চ্যালেঞ্জকে নানাবিধ কর্ম-কৌশল অবলম্বন করে আমাকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। বরং বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তর, বেশ কয়েকজন রাঙ্গামাটিস্থ বাঙালি ব্যবসায়ী আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে আমাকে চির কৃতার্থ করেছিলেন। কতিপয় চাকমা জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমার শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম তথা অনাথ আশ্রম পরিচালনার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। সময়টি হবে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। সে- সময় রাঙ্গামাটি জেলার সমাজসেবা অধিদপ্তরে ডেপুটি ডাইরেক্টরের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন জনাব শাহাবুদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রায় প্রতিমাসেই ‘মোনঘর শিশু সদন’ পরিদর্শন করতে যেতেন। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাকে নির্দেশ দিয়ে তিনশ জন অনাথ ছাত্র-ছাত্রীর মাথাপিছু মঞ্জুরি আবেদন সম্বলিত একটি দরখাস্ত বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচারক বরাবর তৈরি করে তা তাঁর হাতে প্রদান করতে বললেন। তিনি ও ওই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ৬৪টি জেলার ৬৪ জন ডেপুটি ডাইরেক্টর ও ৬৪ জন সরকার কর্তৃক মনোনীত জেলা পর্যায়ের সমাজসেবকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিতব্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে জনাব মো. শাহাবুদ্দিন আহমেদ সাহেব রাঙ্গামাটিস্থ ‘মোনঘর শিশু সদনে’ আশ্রিত নয়শ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্য থেকে তিনশ ছাত্র-ছাত্রীর মাথাপিছু মঞ্জুরি বরাদ্দ প্রদান করার জন্য সমাজ সেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে জোর আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু জনাব শাহাবুদ্দিন আহমেদ সাহেবের বক্তব্যের পর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সরকার মনোনীত সমাজসেবক ওই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মহোদয় না-কি তাঁর বক্তব্যে জোরালোভাবে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে’ ‘মোনঘর শিশু সদন’কে সাহায্য করা হলে প্রকারন্তরে শান্তিবাহিনীকে সাহায্য করা হবে। ‘মোনঘর শিশু সদন’ হলো শান্তিবাহিনীর আখড়া।’
অতএব ওই ঘটনার ফলে ‘মোনঘর শিশু সদন’কে বেষ্টন করে সামরিক বাহিনীর ও আধা-সামরিক বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প একমাসের মধ্যে গড়ে উঠলো। ‘মোনঘর শিশু সদনে’ রাত্রিকালীন টহল শুরু করা হলো। এতে ‘মোনঘর শিশু সদনে’র অহিত করতে গিয়ে অশেষ হিত সাধিত হলো। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের তখনকার মাননীয় জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল আবদুল মন্নাফ পিএসসি মহোদয়ের সাথে আমার হরিহর আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠে। আঞ্চলিক রাজনীতিক দলসমূহের অযাচিত, অপ্রত্যাশিত আধিপত্যমূলক Interference কমে গেল। ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মহোদয় ‘মোনঘর শিশু সদন’ পরিদর্শন করেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে দিঘীনালাস্থ ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমের ক্যাম্পাসের মধ্যে নবনির্মিত ‘অনাথ আশ্রম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়’ ভবটি আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধনের জন্যে তিনি হেলিকপ্টারে করে তথায় গমন করেছিলেন। তিনি তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। ‘মোনঘর’ পালি কলেজ ভবন এর নির্মাণ-ব্যয়ও তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে নির্বাহ করেছিলেন। ওই ভবনটি উদ্বোধনের জন্যে তিনি মোনঘরে গমন করেন। সতেরো একর এলাকার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মোনঘরের সকল স্থাপনা পরিদর্শন করে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মহোদয় প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করার পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প তথায় গড়ে-ওঠায় মোনঘরের আশ্রিত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার স্কাউট সংগঠক জনাব নুরুল আবছার সাহেব ‘বয়স্কাউট’ ও বালিকাদেরকে নিয়ে ‘গার্লস গাইড’ কার্যক্রম চালু করতে সক্ষম হন। তার আগে শত চেষ্টা করেও মোনঘর কর্তৃপক্ষ ‘বয়স্কাউট’ ও ‘গার্লস গাইড’ কার্যক্রম শুরু করতে পারে নি। শরীর চর্চার জন্যে অনাথ বালক-বালিকারা মাঠে নামলেই শান্তিবাহিনীর ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে বলে সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের কাছে গোপন প্রতিবেদন যেত। কর্তৃপক্ষকে হয়রানি ও Interrogation- এর আওতায় নেয়া হতো। বস্তুত সামরিক ক্যাম্পসমূহ মোনঘর কমপ্লেক্সের সন্নিকটবর্তী হওয়ায় ও নিয়মিত টহলদারির আওতায় চলে যাওয়ায় অপকারের বদলে মোনঘরের প্রভূত উপকার সাধিত হয়েছিল। কারণ ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল ‘মোনঘর শিশু সদনের’ স্বর্ণযুগ। এ সতেরো বছরের মধ্যে মোনঘরকে আমি ফলে-পুষ্পে সুশোভিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। একথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলার অবকাশ রাখি যে, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল আবদুল মন্নাফ মহোদয়ের সাথে আমার পারস্পরিক আস্থাব্যঞ্জক সুসম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় শুধু ‘মোনঘর’ নয় ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে’র মধ্যে – (১) অনাথাশ্রম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়, (২) ধর্মোদয় পালি কলেজ (৩) অনাথাশ্রম কারিগরী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (৪) ধর্মোদয় বৌদ্ধ বিহার (৫) অনাথাশ্রম ফ্রি মেডিক্যাল এইড সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। অনাথাশ্রম কারিগরী ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে সদাশয় সরকার ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম ভাগে ১৪টি সিঙ্গার সেলাই মেশিন বরাদ্দ দিয়েছিলেন। ওই ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের নির্মাণ-ব্যয়ও নির্বাহ করা হয়েছিল ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের’ অর্থায়নে। ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ-আশ্রমে’র আওতাধীনে সংরক্ষিত তিনশ একর অনুচ্চ পাহাড়ি জমির ওপর নানাবিধ মূল্যবান বনজ, ফলজ গাছ রোপণের জন্য বৃহৎ বনায়ন কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। সেগুন, মেহগনি, কড়ই, চাপালিচ, গামার, ফলন্ত বৃক্ষ কাঁঠাল, আম, জাম প্রভৃতি আর ওষধি বৃক্ষের মধ্যে নিমগাছ, হরিতকি ও বরাহ গাছ লাগিয়ে তিনশ একরের মধ্যে প্রায়ই সেই ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাগানে রূপান্তর করা হয়েছিল। ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ অনাথাশ্রমে রূপান্তর করতে গিয়ে আমার গুরু পরমপূজ্য ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো যে মারাত্মক চ্যালেঞ্জটির সম্মুখীন হন এবং যার ফলে তিনি তাঁর স্বপ্নের অনাথ আশ্রমটি চিরতরে পরিত্যাগ করে চট্টগ্রামে চলে যেতে বাধ্য হন- সেটি হলো আঞ্চলিক রাজনীতির আত্মঘাতি সিদ্ধান্তপ্রসূত অভিঘাত। সেই মর্মযাতনাময় বছরটি ছিল ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ। সে- বছর আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে (সম্মান) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে নিবিড় পড়ালেখায় ব্যাপৃত ছিলাম। গুরু ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরোকে চিরতরে ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’ ত্যাগ করতে বাধ্য করার এক পর্যায়ে মাইনী উপত্যকার জনগণ আমাকে গুরুর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের হাল ধরতে ডেকে পাঠান এবং আমাকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহি পরিষদের সম্পাদকের পদটি গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। সাধারণ সম্পাদকের পদটি গ্রহণ করার পর অনাথাশ্রমের যাবতীয় চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বাস্তবসম্মত প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে তথাকার আশ্রমের পাশর্^বর্তী ধুরন্দর প্রতিক্রিয়াশীল ও আশ্রম বিদ্বেষী একটি গ্রুপ সাংঘাতিক প্রতিবন্ধকতা-সৃষ্টির অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। এ গ্রুপটি আঞ্চলিক রাজনীতির সমর্থনপুষ্ট ছিল কি-না আমার জানা নেই। তারা এক পর্যায়ে আমাকে ‘লাল কুত্তা’ আখ্যায় আখ্যায়িত করেছিল। আমার বিরুদ্ধে কামিনী ও কাঞ্চণ সম্পর্কিত এমন কোনো অপবাদ নেই, যা দিয়ে আমাকে তারা ঘায়েল করার অপতৎপরতায় লিপ্ত হয় নি। আমি সেই ঘৃণ্য, হীন, জঘন্য অপবাদসমূহকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে আত্ম-প্রত্যয়ের সাথে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’কে গড়ে-তোলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলাম। এই বারো বছর তথা এক যুগের ব্যাপ্তিকালের মধ্যে আমার অগ্রজ ভদন্ত বিমল ভান্তে, অনুজ ভদন্ত প্রিয়তিষ্য ভিক্ষু, অনুজ ভদন্ত জিনপাল ভিক্ষসহ আর বারো জন বৌদ্ধ ভিক্ষুর আত্মনিবেদিত প্রচেষ্টায় সর্বপ্রকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’ একটি সর্বাঙ্গ সুন্দর অনাথাশ্রমরূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুনের পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গায় এই অনাথ আশ্রমটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। অনাথাশ্রম আবাসিক বিদ্যালয় ভবনটি পুড়িয়ে না দিলেও ছাত্রদের ৬টি আবাসিক ভবন, খাবার ঘর, রান্নাঘর, মন্দির, পালি কলেজ ভবন, মেডিক্যাল এইড সেন্টার, অনাথাশ্রম টেকনিক্যাল স্কুল ভবন, প্রাইমারি স্কুল ভবন দাঙ্গাকারীরা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে যায়। এই অনাথাশ্রমের ২৫০ ছাত্র ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরায় পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচে আর ৫০ জন রাঙ্গামাটিস্থ মোনঘর শিশু সদনে এসে আশ্রয় নেয়।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আমার গুরু ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’টি চিরতরে পরিত্যাগ করে রাঙ্গামাটি হয়ে চট্টগ্রামে চলে যাচ্ছিলেন। সেদিন রিজার্ভ বাজারের লঞ্চঘাট থেকে তাঁকে রাঙ্গামাটি মৈত্রী বিহারে নিয়ে এসেছিলাম। যোগাগোগ ব্যবস্থার দুর্গমতার বিষয়টি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’টি নিয়মনিষ্ঠ তদারকি ও পরিচালনার ব্যাপারে আমার সীমাবদ্ধতার কথা নিবেদন করেছিলাম সেদিন। তার প্রতিকার হিসেবে অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজধানী রাঙ্গামাটির উপকন্ঠে ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে’র একটি শাখা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করে রাঙ্গামাটি থেকেই সরকারি পর্যায়ের অফিশিয়াল কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রস্তাব রেখেছিলাম তাঁর কাছে। শাখা কার্যালয়ের দপ্তর স্থাপনের জন্য গুরুর নিকট দশ হাজার টাকা প্রদান করার আবেদন জানিয়েছিলাম। তিনি আমার প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করে নগদ দশ হাজার টাকা প্রদান করে তার পরের দিনই মৈত্রী বিহার থেকে চট্টগ্রামে চলে যান।
গুরু প্রদত্ত দশ হাজার টাকার বিনিময়ে রাঙ্গাপানি ও ভেদভেদী এই দুই ঐতিহ্যবাহী গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে আমি ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে’র নামে চার একর পাহাড়ি জমি কিনতে গিয়ে মাইনী উপত্যকার কতিপয় দুর্মুখ ও কুচক্রী আমার কাছে জমি বিক্রয় না করার জন্য ঘৃণ্য প্রচারণা চালিয়ে আমাদের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে ধ্বংস করার তৎপরতা চালিয়েছিল। কিন্তু রাঙ্গাপানি ও ভেদভেদী গ্রামের হেডম্যান, কার্বারী ও মুরুব্বি কুচক্রী মহলের ঘৃণ্য প্রচারণার ফাঁদে পা দেন নি। সেই কুচক্রীগণ অগ্রজ বিমল ভান্তেসহ আমার সাথে কর্মরত তিনজন ভিক্ষুকে ‘রক্তবীজের ঝাড়’ বলে আখ্যা দিয়ে রাঙ্গামাটিতে স্থান না দেয়ার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদমূলক জঘন্য প্রচারণা চালিয়ে রাঙ্গামাটির তাবৎ জনগনকে রুখে-দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে রাঙ্গামাটির জনগণ তাদের কথা কর্ণপাত করে নি। গুরু প্রদত্ত টাকা দিয়ে সর্বমোট চার একর পাহাড় ক্রয় করা হয়। তখন ছিল ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ। এক একর পাহাড়ি জমির দাম ছিল মাত্র দুই হাজার পাঁচশ টাকা মাত্র। ক্রয়কৃত জমির ওপর দুই গ্রামের মাঝামাঝিতে সর্বপ্রথম ‘রাঙ্গাপানি মিলনপুর বিহার’ নামে একটি বৌদ্ধমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই বৌদ্ধমন্দিরে অধ্যক্ষ হিসেবে অধিষ্ঠিত হন আমার অনুজ ভদন্ত প্রিয়তিষ্য ভিক্ষু। মন্দিরকে কেন্দ্র করে ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে’র শাখা কার্র্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১৯৭৭-১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আমি ও আমার অগ্রজ ভদন্ত বিমল তিষ্য ভিক্ষু মহোদয় বিএ (অনার্স) এমএ পাশ করে বের হলে অনাথ আশ্রমের কাজ পূর্ণোদ্যমে আরম্ভ হয়। অনাথ আশ্রমের এই শাখা কার্যালয়কে ‘মোনঘর’ নামে আলাদা নামকরণ করা হয়। অগ্রজ বিমল তিষ্য ভিক্ষু মহোদয় ঢাকায় ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ’ নামে আরেকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দাঁড় করান ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। আমি রাঙ্গামাটিস্থ ‘মোনঘর’ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধিতকরণ গ্রহণ করে পরিপূর্ণভাবে ‘মোনঘরে’র কাজে নিজেকে আতœনিয়োগ করি। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ‘মোনঘর আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা ও চালু করা হয়। তার আগে ‘মোনঘরের ছাত্র-ছাত্রীরা রাঙ্গামাটিস্থ রাণী দয়াময়ী হাইস্কুলে পড়তে যেত। মোটামুটি ১৯৮০-১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মোনঘরকে কেন্দ্র করে আঠারোটি অঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু ও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করার সাহস ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখি। বলা যায়, ১৯৮০ হতে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই সতেরো বছর ‘মোননঘরে’র স্বর্ণযুগ ছিল।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুন ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’টি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে – ওই অনাথ আশ্রমের ২৫০ জন ছাত্র ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়ার পর ঢাকার ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘে’র প্রতিষ্ঠাতা আমার অগ্রজ বিমল তিষ্য ভিক্ষু মহোদয় ভারতে চলে যান। কারণ অগ্রজ বিমল ভান্তে ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে’র কার্যনির্বাহি পরিষদের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অগ্রজ বিমল তিষ্য ভিক্ষু চিরতরে ভারতে পাড়ি জমালে ঢাকাস্থ ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘে’র দায়িত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার উপর বর্তিত হয়। আমি প্রতিমাসের ১৫ দিন ঢাকায় ও বাকি পনেরো দিন রাঙ্গামাটিতে অবস্থান করে ‘মোনঘর’ ও ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ’ – এই দুই প্রতিষ্ঠানের তদারকি ও চলমান কর্মসূচিসমূহ চালু রাখতে চেষ্টা করি। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের জমিতে স্থাপনা নির্মাণপূর্বক ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ ও ‘বনফুল প্রাইমারী স্কুল’ প্রতিষ্ঠা ও চালু করি। ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘে’র কার্যনির্বাহি পরিষদের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন আমি যখন পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের নামে নিরানব্বই বছরের জন্য লিজ হিসেবে প্রাপ্ত জমিতে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করতে শুরু করি, তখন চাকমা সমাজের কতিপয় উচ্চপদের সরকারি কর্মকর্তা আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানাতে বদ্ধপরিকর হন। তাঁদের হাতে সত্যনির্ভর কোনো তত্ত্ব, তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও নিছক বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতার বশবর্তী হয়ে আমাকে আদিবাসী সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য, আমার দ্বারা ‘মোনঘর’ ও ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোম’- এ চালুকৃত শিক্ষা বিস্তারমূলক কার্যক্রম অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেয়ার অপতৎপরতার অনুষঙ্গে আমার জীবনান্ত ঘটানোর লক্ষ্যে জঘন্য বেনামি চিঠির বন্যা বইয়ে দিয়েছিল তারা, যার ফলে আমি ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘মোনঘর’ ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ ও পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করতে বাধ্য হই। আমি অব্যাহতি নেয়ার পর অর্থ কেলেঙ্কারি ও নারী কেলেঙ্কারির ওপর ভিত্তি করে আমার বিরুদ্ধে যে বেনামী চিঠির বন্যা বইয়ে দেয়া হয়েছিল। – তার যথার্থতা নির্ণয়করণপূর্বক আমাকে শাস্তি দেয়ার চেষ্টার কোনো ক্রটি তারা রাখে নি। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারে নি তারা। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে ‘মুখ চুন’ করে পুনরায় আমার হাতে তাঁরা ‘মোনঘর’, ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ ও ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘে’র দায়িত্বভার অর্পণ করতে বাধ্য হন। যাঁরা আমার সাথে বিরোধে জড়িয়েছিলেন তাঁরা এখনো জীবিত রয়েছেন বিধায় এখানে তাঁদের নাম উল্লেখ করে তাঁদেরকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাই না। আমি মুসলিম, খ্রিষ্টান ও হিন্দু জনমানসের অভিব্যক্তির বিষয়ে অজ্ঞ। শিক্ষা বিস্তার, জনসেবা, মানবসেবা, মানবকল্যাণমূলক কর্মে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও হিন্দুসমাজ যথেষ্ট প্রাগ্রসর বলে আমার দৃঢ় বিশ^াস। কোনো এক মহৎ ব্যক্তির একটি উক্তি আমি আমার ডায়রিতে টুকে রেখেছিলাম। ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চিন্ত-চেতনা ক্ষুদ্র, নীচ কূপম-ুকতাপূর্ণ হতে বাধ্য। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রাজন্যবর্গ থেকে শুরু করে সামন্তবাদী মানসিকতাসম্পন্ন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারকে আমি দেখেছিলাম ‘মোনঘর’, ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’, ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ নিবিড়ভাবে পরিচালনা করতে গিয়ে তাদেরকে হাড়ে-হাড়ে চিনতে পেরেছিলাম। সেসব প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিবর্গ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অনাথ, অসহায়, ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র সন্তান-সন্ততিরা আধুনিক শিক্ষায়-দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক- তা তাঁরা মোটেই সমর্থন করে না। এ পর্যায়ে সাধনানন্দ ভিক্ষু (বনভিক্ষু), যিনি আদিবাসী সমাজে স্বঘোষিত অর্হৎ নামে আত্ম-পরিচয় দিতে আনন্দানুভব করতেন-তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পূর্বে উল্লিখিত সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার অনুসারী মধ্যবিত্ত ধনিক শ্রেণি আমাকেসহ আমার সহযোগী ভিক্ষুম-লীকে স্বঘোষিত অর্হৎ ভিক্ষুর জবানীতে নানাভাবে নিন্দা, কুৎসা রটনা করার ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। তবে সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠী যে তাদেরকে সমর্থন জানাতো – তা কি নয়। ৮০% জনগণ আমাদের শিক্ষা বিস্তার ও মানব কল্যাণমূলক কর্মযজ্ঞের ভূয়সী প্রশংসা করতেন, সমর্থন দিতেন ও পারতপক্ষে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করতেন। কিন্তু আমাদের কর্মকা-কে যাঁরা বিষ নজরে দেখতেন, সদাসর্বদা প্রতিবন্ধকতা-সৃষ্টির অপতৎপরতা চালাতেন-তাঁরা কিন্তু সকলেই মধ্যবিত্ত ধনিক শ্রেণি। এঁদের মধ্যে দু-একজন জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও রয়েছেন, যাদের নাম এখানে উল্লেখ করে সম্মানহানি করতে চাই না।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষ ভাগে ‘মোনঘর’, ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ ও পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের দায়িত্বে দ্বিতীয়বার অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আমি সাংঘাতিক আর্থিক দৈন্যদশায় নিপতিত হই। ভুটানের রাষ্ট্রদূত থাকা অবস্থায় মি. শরদীন্দু শেখর চাকমা আমাকে ও আমার কার্যনির্বাহি পরিষদকে নিয়ে এমন একটি আত্মঘাতি চিঠি আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের বরাবরে লিখলেন, যার ফলে ‘মোনঘর’ ও ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস- এর বিপরীতে প্রদত্ত অর্থসাহায্য তাঁরা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন। আমি অকূল সাগরে নিপতিত হলাম। সেই যুগ-সন্ধিক্ষণে, সেই ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মি. কল্পরঞ্জন চাকমা ‘মোনঘর’সহ আরো তিনটি অনাথ আশ্রমের কার্যক্রম চালু রাখার স্বার্থে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতাধীনে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প’ নাম দিয়ে সদাশয় সরকারের তহবিল থেকে দশ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করে মোনঘরকে সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। প্রকল্পটি তিনি ‘পার্বত্র চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে’র তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। ‘মোনঘর’ সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত মোনঘরসহ আরো তিনটি শিশুসদন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে এসেছি। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প’টি বন্ধ করে দেয়া হয়।
‘মোনঘর’ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছিল বিধায আমি ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝিতে মিরপুরস্থ শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারে এস পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের স্থাপনায় ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’-এর আদলে ‘বনফুল প্রাইমারী স্কুলে’রই পরিণত ও পরিবর্তিত রূপকল্প হিসেবে ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের সাতজন কার্যনির্বাহি সদস্যের উদ্যোগে ‘বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট’ গঠন করি। ট্রাস্টটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে কলেজ প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক কার্যক্রম গ্রহণ করি। কিন্তু মি. শরদীন্দু শেখর চাকমাসহ আরো তিনজন আমার এই কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজটি অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেয়ার লক্ষ্যে আমার বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করলেন যে, আমি না-কি ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘে’র নামীয় জায়গাটি বাঙালিদের কাছে বিক্রয় করে-দেয়ার অপতৎপরতায় আত্মনিবেদিত রয়েছি ও বাঙালিদের কাছে স্থাপনাসহ পুরো জায়গাটি বিক্রি করে দিচ্ছি।
কলেজ শুরুর প্রারম্ভিক পর্বে আমরা পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহি পরিষদের সাতজন আদিবাসী সদস্য কলেজটি পরিচালনার জন্য অ্যাডভোকেট করুণাময় চাকমার তত্ত্বাবধানে সর্বপ্রথম একটি ট্রাস্ট দলিল তৈরি করেছিলাম। ট্রাস্ট দলিলটি মিরপুরের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দ্বারা নিবন্ধিকরণ তথা রেজিস্ট্রি করার পর কলেজের কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করি এবং কলেজটি চালু করার জন্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে প্রাথমিক অনুমোদনের জন্য প্রার্থনা জানাই। শরদীন্দু শেখর ও তাঁর আরো তিনজন সহযোগীর রিট মামলার কপি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়ের হাতে এসে পৌঁছলে চেয়ারম্যান মহোদয় রিট মামলা স্বতঃস্ফূর্ভাবে খারিজ করে না নিলে তিনি কলেজের প্রাথমিক অনুমতি দিতে অপারগ বলে আমাকে ডেকে জানিয়ে দিলেন। আমি ও ট্রাস্ট সদস্যগণ এতে অকূল সমুদ্রে নিপতিত হলাম। বাধ্য হয়ে আমি পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের বিশেষ সাধারণ অধিবেশন ডাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের বিশেষ সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো। অধিবেশনে আমার বিশেষ আমন্ত্রণে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান মি. জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা মহোদয় উপস্থিত ছিলেন। এই অধিবেশনে রাজধানী ঢাকার সাতানব্বই জন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উচ্চপদস্থ আমলা থেকে শুরু করে তখনকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপমন্ত্রী মি. মণি স্বপন দেওয়ান মহোদয়ও উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশনে ট্রাস্টের দলিলটি অনুপুঙ্খ পঠিত হলো। টেকনিক্যাল কমিটির প্রতিবেদন পঠিত হলো। এগারো জন বক্তা কলেজ চালু করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করলেন। মাত্র দুজন বক্তা কলেজ চালু করার বিপক্ষে মতামত রাখলেন। উপমন্ত্রী মহোদয় বক্তব্য রাখলেন। আমাকে বেশ কিছু প্রশ্নবাণ ছুড়ে দিলেন। তাঁর গোটা বক্তব্যটি ছিল হ্যাঁ ও না উভয় কোটিক। তাঁর বক্তব্যের পর আমি তাঁর ছুড়ে-দেয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে শুরু করলাম। আমার বক্তব্যের মাঝখানে আঞ্চলিক পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয় বললেন, ‘ভান্তে, এতগুলি প্রশ্ন আপনি উত্তর দিতে সময় পাবেন না। বরঞ্চ আমাকে মাইকটি হস্তান্তর করেন। ’ তিনি আমার কাছ থেকে মাইকটি নিয়ে বল্লেন, ‘‘এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আমি ভারতের অনেক জায়গায় দেখেছিলাম। সেখানে ব্যক্তি-পর্যায়েও এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সামষ্টিক পর্যায়েও গড়ে উঠেছে। ভান্তে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের কার্যনির্বাহি পরিষদের সাতজন সদস্য/সদস্যাকে নিয়ে ট্রাস্ট গঠন করে ট্রাস্ট্রের দ্বারা ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’টি পরিচালনা করতে চাচ্ছেন। এতে অনৈতিক কোনো কিছু আমি দেখতে পাচ্ছি না। অতএব, তাঁদেরকে কলেজটি চালু করতে দেয়া হোক। ভান্তে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের এ স্থাপনাটি যদি সত্যি-সত্যি বাঙালিদের কাছে বিক্রয় করে দেয়ার অপতৎপরতায় লিপ্ত হন, তাহলে আমরা আদিবাসী নেতৃবর্গ কি ঘুমিয়ে থাকবো?’’ উপস্থিত সুধিমন্ডলী সকলেই একবাক্যে মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়ের সুচিন্তিত মতামত মেনে নিয়ে সানন্দে কলেজ চালু করার পক্ষে সাধুবাদ জানান। এই বিশেষ সাধারণ সভার সিদ্ধান্তের পর মি. শরদীন্দু শেখর ও তার তিনজন সহযোগী হাইকোর্টের রিট পিটিশন Withdraw করলেন। আমরা ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ চালু করার জন্য বোর্ডের অনুমতি লাভ করে চিরকৃতার্থ হলাম।
রাজধানী ঢাকা শহরের বুকে একটি মানসম্মত কলেজের সমপর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষের অপরাপর সদস্যবর্গসহ আমি ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে’র সকল পর্যায়ের উন্নয়নের কাজে মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে আত্মনিয়োগ করলাম। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই থেকে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিমাসে ২০ দিন ঢাকায় ও বাকি ১০ দিন রাঙ্গামাটিতে অবস্থান করে ‘মোনঘর’ ও ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’ পরিচালনায় আমি আত্মনিবেদিত ছিলাম। বাংলাদেশ সরকারের পটপরিবর্তনের অনুষঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানের বিশেষ সহকারী হিসেবে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়কে নিয়োগ দিয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে’র দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করা হলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ‘মোনঘর’ -এর সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। ‘মোনঘর’ আবার কঠিন সমস্যায় নিপতিত হলো। ঠিক সেই মোক্ষম সন্ধিক্ষণে আমাকে ‘মোনঘর’ থেকে সরিয়ে-দেয়ার তৎপরতা শুরু হলো। এই তৎপরতা শুরু করেছিল আমারই হাতে-গড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রিধারী জনা দশেক ছেলে। তাঁরা সকলেই আমার থেকে বেশি শিক্ষিত, ইংরেজিতে দক্ষ, ফরাসি ভাষায় দক্ষ, উপরন্তু তারা সকলেই UNDP-তে খুবই উচ্চতর পজিশনে কর্মরত। দেড়-দুলক্ষ টাকা মাসিক বেতনের আশীর্বাদপুুষ্ট আদিবাসী পুঙ্গব। বস্তুত তাঁরা কিন্তু সকলেই মোনঘরেরই ফসল, যে ফসলের জন্যে আমি আমার জীবন, যৌবন, ধন, মান- জীবনের সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছিলাম। সর্বপ্রথম মি. কীর্তি নিশান চাকমা, ভদন্ত বুদ্ধদত্ত ভিক্ষু ও মি. সুমিত্র চাকমা আমার বনফুলের আবাস কক্ষে গিয়ে এটুকু বলার প্রয়াস পেলেন যে, আমি ‘মোনঘর’ কার্যনির্বাহি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকলে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও জাপান কোনো ধরনের অনুদান দেবে না। এভাবে তাঁরা তিনবার এরূপ বলে আমাকে অনতিবিলম্বে অব্যাহতি গ্রহণ করে ‘মোনঘর’কে সমূহ ধ্বংসের হাত রক্ষা করার আবেদন জানালে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ আমি রাঙ্গামাটিতে গিয়ে আনন্দ বিহারের সম্মেলন কক্ষে মোনঘর-এর কার্যনির্বাহি পরিষদের বৈঠক আহ্বান করি। এখানে উল্লেখ্য, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে মোনঘরের সাধারণ সদস্য/সদস্যার উপস্থিতিতে সাধারণ সভা ডেকে আমার নেতৃত্বে এগারো সদস্য/সদস্যা বিশিষ্ট ‘মোনঘর কার্যনির্বাহি পরিষদ’ নতুনভাবে গঠিত হয়েছিল। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, পূর্বে External Resources Division থেকে ‘মোনঘর’ বৈদেশিক অনুদান গ্রহণ করার অনুমতি লাভ করলেও NGO Registration লাভ করতে সক্ষম হয় নি। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আমি দ্বিতীয়বার মোনঘরের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলে ছয় মাসের একটানা প্রচেষ্টায় বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ‘মোনঘর’ এনজিও ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশন পাঁচ বছরের জন্য লাভ করতে সক্ষম হই এবং ব্যুরোর দ্বারা প্রদত্ত মোনঘরের পাঁচ বছরের ব্যাপ্তিকাল ছিল ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। আমি বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে’র কাজে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, মোনঘরের NGO ব্যুরোর Registration নবায়নের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে NGO ব্যুরোর Registration নবায়ন করা আমারই নৈতিক দায়িত্ব। সে-সময় ঘএঙ ব্যুরোর অন্যতম পরিচালক হিসেবে ড. আলাউদ্দিন সাহেব অধিষ্ঠিত ছিলেন। ড. আলাউদ্দিন সাহেবের তিনজন ছেলেমেয়ে আমার দ্বারা পরিচালিত ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে’ পড়ালেখা করতো। তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ। মোনঘরের NGO ব্যুরোর Registration নবায়নের কার্যক্রম দেড় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি আমি তাঁর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম ও এ ব্যাপারে আমি তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করি। তিনি আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে এমন একজন করিৎকর্মা ব্যক্তিকে এ কাজে নিয়োজিত করলেন যে, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর হতে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারির মধ্যে মোনঘরের NGO Registration আরো ৫ বছরের জন্য নবায়ন কাজ শেষ করতে সক্ষম হলাম। এ কাজটি নির্মোহভাবে সম্পন্ন করে আমাকে চিরকৃতার্থ করেছিলেন NGO ব্যুরোরই একজন কর্মকর্তা- তাঁর নাম মো. আমজাদ। মো. আমজাদ সাহেব এখনো আমার অন্তরের অন্তস্তলে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত একজন পরম কল্যাণ-মিত্র। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখের দিকে আরো পাঁচ বছরের জন্য ঘএঙ ব্যুরো কর্তৃক নবায়িত ‘মোনঘরে’র সনদপত্রটি মোনঘর অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। যদ্দুর সম্ভব NGO ব্যুরোর নবায়নকৃত মোনঘরের সনদপত্রটি পেয়েই মি. কীর্তি নিশান ও তাঁর গং শতগুণ শক্তি সঞ্চয় করে আমার বিরুদ্ধে আমাকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে কোমড় বেঁধে নেমে পড়ে। ‘মোনঘর’-এর প্রত্যক্ষ অর্থায়নে সবচাইতে সুবিধাভোগী যে দশজন ‘মোনঘরে’র (বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রিধারী) ছাত্র আমাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তারা হলেন মি. কীর্তি নিশান চাকমা, মি. প্রিয়তর, মি. সুমিত্র, মি. অশোক, মি. বিপ্লব, মি. সমর বিজয়, ভিক্ষু বুদ্ধদত্ত, মি. বিধায়ক ও মি. অনোমদর্শী দেওয়ান। তারা মোনঘরের নতুন কার্যনির্বাহি পরিষদকেও আমার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করার জন্য প্ররোচিত করে। এতদকারণে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চের কার্যনির্বাহি পরিষদের বৈঠকের দিন পরিষদের অধিকাংশ সদস্য আমার অব্যাহতি গ্রহণের পক্ষে অবস্থান নেন। সেদিন আরেকটি অসহনীয় চরিত্র হননকারী, অবমাননাকর ও অপমানজনক কুৎসা আমার বহুদিনের স্নেহসিক্ত অনুজ ভিক্ষু প্রদ্ধালংকার মহাথেরোর মুখ থেকে বের হলো-‘আমি না-কি বিগত তিন বছরের মধ্যে শুধুমাত্র চাউলের খাত থেকে তিন কোটি টাকা পকেটস্থ করেছিলাম।’ এই কুৎসার জবাব হিসেবে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মি. কল্পরঞ্জন চাকমা কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে, বোর্ডের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প’ নাম দিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করে মোনঘরসহ আরো তিনটি শিশুসদন পরিচালনা করার নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। এমতাবস্থায় ‘কোন পদ্ধতিতে আমি শুধুমাত্র চাউলের খাত থেকে তিন কোটি টাকা পকেটস্থ করলাম?’ জানতে চাইলে মোনঘর কার্যনির্বাহি পরিষদের সকল সদস্য/সদস্যা পিনপতন নীরবতা অবলম্বনপূর্বক ভদন্ত শ্রদ্ধালংকারের বক্তব্যকে প্রকারান্তরে সমর্থন জানান বলে আমার অনুমিত হলো। আমার চরিত্রে এই ঘৃণ্য, হীন, জঘন্য অবমাননাকর কলঙ্ক লেপনের লক্ষ্যে উচ্চারিত কুৎসার বিচার চেয়ে মোনঘর কার্যনির্বাহি পরিষদের তখনকার সভাপতি মিস আরতী চাকমার কাছে একটি দরখাস্ত পেশ করি। ওই দরখাস্তের অনুলিপি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, মহোদয়ের কাছেও প্রদান করি। কিন্তু এখনো ওই বিচারটি নিষ্পত্তি করার তাগিদ কেউ অনুভব করেন নি। আমার দরখাস্তে আমি দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলাম, আমি যদি তিন কোটি টাকা পকেটস্থকরণের দোষে দোষী সাব্যস্ত হই, তাহলে আমি জেলখানায় যেতে চাই। বৈঠকের সাতদিন পর Global Corruption Watch নামের একটি ওয়েবপেইজে কে বা কারা লিখেছিল, `According to Shraddhalankar’s Voice Prajnanda Mahathera kept ও Core of illegal money within three years.’ এই তিন কোটি টাকা পকেটস্থ করার বিচারটি নিষ্পত্তি না হওয়ার দরুন আমি শপথ করেছিলাম যে, ‘আমি আর এ জীবনে মোনঘরে পা দেবো না।’ এই ঘটনাক্রম সাত বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। এই সাত বছরের মধ্যে আমি একবারও মোনঘরে আমার অপবিত্র পা স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখাই নি। ভাগ্যের অথবা কর্মের কী নির্মম পরিহাস।
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ মোনঘর কার্যনির্বাহি পরিষদের যে বৈঠক ডেকেছিলাম-তাতে কার্যনির্বাহি পরিষদের আমি এবং দশজন সদস্য/সদস্যা ও মোনঘর প্রশাসনের চিফ হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাসহ অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ প্রকল্প কর্মকর্তাদের তিনজন এবং অনাহুতভাবে মি. কীর্তি নিশান চাকমা উপস্থিত ছিলেন। সেই তারিখের বৈঠকে ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথেরো মহোদয় আমার তিন কোটি টাকা পকেটস্থ করার ব্যাপারে যে অভিযোগটি উত্থাপন করেছিলেন সেই একই অভিযোগ ১৭/০৩/২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ তারিখ Global Corruption Watch প্রকাশ করায় আমাকে বিশ^ব্যাপী হেয় প্রতিপন্ন করার ষোলকলা পূর্ণ হয়। ভুল ইংরেজিতে Global Corruption Watch-এ আমাকে নিয়ে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল-সেটির হোতা মি. কীর্তি নিশান চাকমা বলে আমার দৃঢ় বিশ^াস। ইচ্ছাকৃতভাবে আমার সাথে শ্রদ্ধালংকার মহাথেরোর দূরত্ব সৃষ্টি করে খুবই সূক্ষ¥ভাবে শ্রদ্ধালংকার মহাথেরোকে দিয়ে এ কাজটি তাঁরা করিয়ে নিয়েছেন। এখন আমি তিন কোটি টাকার অবৈধ অর্থ পকেটস্থ করার দুর্নামের দুঃসহ যন্ত্রণা বুকে ধারণ করে ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে’র তৈরি করে দেয়া আবাসস্থলে মর্মযাতনাময় জীবন-যাপন করে যাচ্ছি।
‘মোনঘর’ ছিল আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসা, আমার কর্মসংস্কৃতির আধার। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ-এই দীর্ঘ ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) বছরের ব্যাপ্তিকালে আমার তিল-তিল রক্ত ও স্বেদবিন্দু দিয়ে কমপক্ষে ২০টি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলাম। ১০৮ একর পাহাড়-জমি ও ২৫.৮১ ডেসিমেল ধান্য জমি ‘মোনঘরে’র নামে ক্রয় করেছিলাম। ১৪/১৫টি পাকা ও আধা পাকা বিল্ডিং তৈরি করেছিলাম। চার সহস্রাধিক অনাথ, অসহায়, ছিন্নমূল ও দতদরিদ্র সন্তানসন্ততিদের মধ্য থেকে সহস্রাধিক সন্তানসন্ততিকে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের উপযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিশীল ও আশীর্বাদপুষ্ট সুনাগরিক হিসেবে তৈরি করেছিলাম। বর্তমানে টঘউচ-তে কর্মরত মি. প্রিয়তর চাকমা, বিপ্লব চাকমা, সমর বিজয় চাকমা, প্রিয়তর চাকমা, কীর্তি নিশান চাকমাসহ কমপক্ষে ত্রিশ জন উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত মোনঘরের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছেন, যারা উচ্চপর্যায় থেকে একেবারে মাঠ-পর্যায় পর্যন্ত টঘউচ’র নানা পদে অধিষ্ঠিত। যে দশজনের নাম পূর্বে উল্লেখ করেছিলাম-তাদের মধ্য থেকে মি. কীর্তি নিশান, ভদন্ত বুদ্ধদত্ত ভিক্ষু, মি. সুমিত্র, মি. অশোক ও মি. বিপ্লব-এই পাঁচজন একটি গ্রুপ গঠন করে পর পর তিনবার আমার আবাসস্থলে গিয়ে আমাকে ‘মোনঘরে’র সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি নিতে চাপ সৃষ্টি করেছিল।
আওয়ামী লীগের সম্মানিত সাংসদ মি. দীপংকর তালুকদারকে ‘মোনঘরে’র সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে আমাকে অব্যাহতি নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করার বিষয়টি জানালে তিনি আমার বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে জানালেন। ছয় মাসের জন্য আমাকে অন্যদেশে গিয়ে অবস্থান করতে তিনি অনুরোধ করেছিলেন। ছয় মাস পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ‘মোনঘরে’ সাহায্য দেয়া হবে বলে আশ^স্ত করেছিলেন। কিন্তু ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে’র সার্বিক ব্যাপারে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আত্মনিবেদিত থাকার দরুন তাঁর অনুরোধ রক্ষা করা আমার দ্বারা সম্ভব হয় নি। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চের মোনঘর কার্যনির্বাহি পরিষদের বৈঠকের পর ১৫ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান মি. জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা মহোদয় আমাকে তাঁর দপ্তরে ডেকে পাঠালেন এবং আমাকে অব্যাহতি নিতে পরামর্শ দিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২৩ মার্চ ২০০৮ তারিখ মোনঘরের সম্মেরন কক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়ের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত মোনঘরের সাধারণ সভায় আমি আনুষ্ঠানিক ইস্তফা পত্র প্রদানপূর্বক মোনঘর থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করি। ছয় মাস পর বাংদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ক্যাবিনেট গঠন করলো। রাঙ্গামাটি থেকে নির্বাচিত সম্মানিত সাংসদ মি. দীপংকর তালুকদার এম.পি. মহোদয় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলেন। ক্যাবিনেট গঠন করার পর পরই ড. প্রদানেন্দু ও মি. কীর্তি নিশান চাকমা, বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে আমার দপ্তরে এসে ‘মোনঘর’ পরিচালনার জন্য সদাশয় বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে আঠারো কোটি টাকার অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে সুপারিশসহ মাননীয় প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার এম.পি.-কে প্রকল্পটি গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করতে আমাকে অনুরোধ জানালেন। আমি একাজটি করতে অপারগতা প্রকাশ করলাম। তারা আঠারো বার আমার কাছে এসে প্রকল্পটির অনুকূলে আমার সমর্থন আদায়ের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিল। তাদেরকে আমি এরূপ বলেছিলাম, ‘আমি মোনঘরের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করলে তোমরা মোনঘর পরিচালনার জন্য আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনুদান পেয়ে ধন্য হবে বলে জোর গলায় বলেছিলে। এখন বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে কেন? বাংলাদেশ একটি দরিদ্রতম দেশ। তোমরা তো উপরন্তু বাংলাদেশ সরকারকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে সরকারের সার্বিক জনকল্যাণকর কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হতে পারো। অতএব, আটান্ন বছর পূর্বে মৃত আমার বাবা নরেন্দ্র লাল চাকমা আমার কাছে এসে অনুরোধ করলেও প্রস্তাবিত আঠারো কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে আমি মি. দীপংকর বাবুকে কোনো কথা বলবো না।’’ বস্তুত ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ হতে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’, ‘মোনঘর’ ও ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ পরিচালনা করতে গিয়ে যেসব সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলাম-সেগুলো হলো-ক) মধ্যবিত্ত ধনীক শ্রেণির অবহেলা ও ঘৃণা মিশ্রিত পরশ্রীকাতর শিক্ষা বিমুখতা। বিশেষ করে অনাথ, অসহায়, ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র সন্তানসন্ততিদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারকে তারা নারকীয় কাজ বলে প্রচার করার প্রয়াস পেতেন। খ) ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধনানন্দ ভিক্ষু (বনভিক্ষু) স্বঘোষিত অর্হৎ ও তাঁর অন্ধভক্তবৃন্দ ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’, ‘মোনঘর’ ও ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’-এর শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রমে সাংঘাতিক প্রতিবন্ধকতা’-সৃষ্টির তৎপরতায় আত্মগত ছিল। তারা মনে করতো ‘নেয়্যা নাধংসা’ সন্তানসন্ততিদেরকে আধুনিক পড়াশোনায় শিক্ষিত করে গড়ে-তোলার প্রক্রিয়া নরক গমনে দ্বার উন্মুক্ত করার শামিল। গ) স্বঘোষিত অর্হৎ সহ তার অক্ষশক্তির অন্ধভক্তরা প্রচার করতো, অনাথ আশ্রম পরিচালনা করা সংসারত্যাগী ভিক্ষুদের কাজ নয়। ভিক্ষুদের কাজ হলো ধ্যান-ভাবনার মধ্য দিয়ে দুঃখ মুক্তি। অথচ বুদ্ধের জীবদ্দশায় ও ভিক্ষুসংঘ দুই ধারায় বিভক্ত ছিল। তা হলো ধর্মকথিক ও বিনয়ধারী। ধর্মকথিকপন্থি ভিক্ষুরা বুদ্ধের মুখনিঃসৃত বাণী পর্যালোচনা করতেন, গবেষণা করতেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে আকর্ষণীয়ভাবে সাধারণ জনগণের মাঝে প্রচার করার প্রয়াস পেতেন। তাঁরা বুদ্ধের মুখনিঃসৃত বাণীর টিকা-টিপ্পনী তৈরি করে কোথাও বুদ্ধবাণীর অস্পষ্টতা, যুক্তিহীনতা পরিলক্ষিত হলে সুস্পষ্ট ও যুক্তিগ্রাহ্যভাবে উপস্থাপন করে জনসাধারণের সংশয় নিরসন করার প্রয়াস পেতেন। এ ধর্মকথিক ভিক্ষুদের অবস্থান ছিল সাধারণ খেটে-খাওয়া জনসাধারণের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার কাছাকাছি। সাধারণ জনসাধারণের যাপিত জীবনের অনুষঙ্গসমূহের মধ্যে অহিংসা, মৈত্রী, মানবতার বাতাবরণ নিষ্কলুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার নির্দেশনা দানের মধ্য দিয়ে ধর্মকথিক ভিক্ষুরা সাধারণ জনসাধারণের পরমাতœীয় ও পরম কল্যাণ-মিত্রের ভূমিকা পালন করার প্রয়াস পেতেন। ধর্মকথিকরা ধর্মগ্রন্থ রচনা করতেন, ধর্মপ্রচার করতেন, ধর্মগবেষণা করতেন, ধর্মপ্রচারে গ্রামে-গঞ্জে, নগর থেকে নগরান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে গমন করে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতেন। অপরদিকে বিনয়বাদী ভিক্ষুরা একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে অবস্থান করে ধ্যান-ভাবনায় আত্মনিমগ্ন থেকে দুঃখমুক্ত হওয়ার সাধনায় নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যাপৃত থাকতেন। নিরবচ্ছিন্নভাবে আত্ম-দর্শনে আত্ম-নিবেদিত থাকার দরুণ তাদের দ্বারা ধর্মপ্রচার, ধর্মগ্রন্থ রচনা, ধর্ম গবেষণা, সম্ভবপর হতো না। তাই বুদ্ধের জীবদ্দশায় এই দুই ধারার ভিক্ষুরা ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু বর্তমান এই একবিংশ শতাব্দীতে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন আর পূর্ববৎ নেই। অধিকাংশ বিনয়বাদী ভিক্ষুদের মধ্যে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাঁরা এখন ‘নরের মন নারায়ণ জানেন’ অবস্থা। তারা আত্মচর্চার পরিবর্তে পরচর্চায় লিপ্ত থাকেন। এরূপ পরচর্চাকারী ভিক্ষু ও তার অক্ষশক্তির লোকেরা আমার শিক্ষা সহায়ক কর্মযজ্ঞে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চলমান গতিকে শ্লথ করে দিয়েছিল। ঘ) আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সংশয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস প্রবণ মনমানসিকতা আমার শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে। তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তা-চেতনা, অযাচিত জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে চলমান কার্যসূচিসমূহের গতি শ্লথ করে দেয়া, অযাচিত খবরদারি-এসব ছিল তাদের নিত্য নৈমিত্তিক রুটিন কাজ। ঙ) ‘মোনঘর’, ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ ও ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অদক্ষতা, কাজে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা, কর্তব্য সম্পাদনে পলায়নী মনোবৃত্তি, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পৃক্ত থেকে প্রতিষ্ঠানের ওপর অনাকাঙ্কিত খবরদারি করার প্রত্যাশা আমার কাজের গতিকে ব্যাহত করতে না পারলেও শ্লথ করে দিয়েছিল। চ) দু-এক জন জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ‘মোনঘর’, ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’-এর অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন। তাঁরা সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের মাধ্যমে আমার কাজের চুলচেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় নিয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত করে আমার চলমান কার্যক্রম পুরোপুরি স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টায় চেষ্টিত ছিলেন। কিন্তু আমার চলমান কর্মসূচিসমূহের মধ্যে কোনো রকম গলদ না থাকায় শত চেষ্টা করেও তারা কৃতকার্য হন নি। তবে স্বাভাবিক গতিকে তারা শ্লথ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। আমাকে যথেষ্ট মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রম নির্ভর হয়রানি করে আমার শরীর ও স্বাস্থ্যের বারোটা বাজিয়েছে এবং ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। ছ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি ও সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক অনটন, দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব, দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ, ন্যায়পরায়ণ, মানবদরদি জনশক্তির অভাব, ত্যাগময় দীক্ষায় দীক্ষিত সংঘ শক্তির অভাব, তথা ভিক্ষুসংঘের অভাব আমার কাজে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে শত সহস্র ভিক্ষু সংঘ থাকলেও সকলেই আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে পারঙ্গম বিধায় মানবকল্যাণমূলক কাজে তারা নিতান্তই পরাক্সমুখ। তারা ধ্যান-সমাধির কোনো স্তর লাভ না করা সত্ত্বেও ইশারা-ইঙ্গিতে তাদের ধ্যান স্তর লাভ করার বিষয়টি ধর্মান্ধ, অজ্ঞানতা, বুদ্ধের যুক্তিনির্ভর ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ, সহজ, সরল জনসাধারণের মাঝে বিঘোষিত করে স্বর্গ, মোক্ষ, নির্বাণের লোভ দেখিয়ে তাদের পকেট ভারি করছে অতীব আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে। এভাবে তারা সাধারণ জনগণের পকেট খালি করে যাচ্ছে অনবরত। এ ধরনের ভিক্ষুরাও আমার মানবিক ও জনকল্যাণমূলক শিক্ষাবিস্তার কর্মযজ্ঞের ক্ষেত্রে প্রভূত চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। জ) ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের পর ‘মোনঘরে’র অর্থায়নে বিশ^বিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে বের হওয়া কতিপয় ছাত্র আমার কাছ থেকে ‘মোনঘর’-এর ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তারাই মোনঘরের সার্বিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রত্যাশায় জঘন্য মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া, অসভ্য কুৎসা সম্বলিত বেনামী চিঠি সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। এ অপতৎপরতা ‘মোনঘর’ ও ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরূপ বেনামী চিঠির বন্যার ধাক্কায় উন্নয়ন সহযোগীরা আমাকে ‘মোনঘর’, ‘চিলড্রেন্স হোমস’ ও ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘে’র দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালে আমি ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করি। আমার বিরুদ্ধে আনীত বেনামী চিঠিতে উল্লিখিত সকল অভিযোগ পাতি-পাতি ও তত্ত্ব-তালাশ করে কোনো প্রকার অভিযোগের সত্যতা ও যথার্থতা তারা প্রমাণ করতে পারে নি। অর্থ কেলেঙ্কারির কোনো প্রকার প্রমাণও তারা আবিষ্কার করতে পারে নি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আমাকে তিনমাস সময় বরাদ্দ করলেও মাত্র তিন দিনের মধ্যেই ড. প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আনন্দ বিহারে চলে যাই। আমার বিরুদ্ধে আনীত অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ তত্ত্ব-তালাশ করার সুযোগ দেয়াই হলো এর একমাত্র কারণ। কিন্তু তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে ‘মোনঘর’ ও ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’-এর সার্বিক কার্যক্রম চালাতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই তারিখ প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনার দায়িত্বভার পুনরায় আমার হাতে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। ঝ) ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝিতে আমি দ্বিতীয়বার ‘মোনঘর’ ও ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’-এর দায়িত্বভার হাতে নেয়ার পর তদানীন্তন সরকারের ভুটানের রাষ্ট্রদূত মি. শরদেন্দু শেখর চাকমা রাষ্ট্রদূতের লেটার হেড-এ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে এমন একটি চিঠি লেখার প্রয়াস পেলেন, যার অছিলায় উন্নয়ন সহযোগীরা ‘মোনঘর’ ও ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’-এর অনুদান প্রদান চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটিই ছিল আমার শিক্ষা প্রসার ও শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রমের চরমতর বিধ্বংসী চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে উন্নয়ন সহযোগীদেরকে ফিরিয়ে আনা আমার দ্বারা আর সম্ভব হয় নি। শরদীন্দুর লেখা চিঠি এখানে সংযুক্ত করা হলো।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে ও ওপরে উল্লিখিত চ্যালেঞ্জসমূহ বহাল তবিয়তে বিরাজমান। আরো কিছু-কিছু মারাত্মক আত্মঘাতি চ্যালেঞ্জ আদিবাসী সমাজের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে, যা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এখানে পর্যায়ক্রমিকভাবে তুলে-ধরার প্রয়াস পেলুম। তবে এসব বদগুণ আদিবাসী সমাজের মধ্যেই বিরাজমান। অন্য সমাজ-মানসে রয়েছে কি-না আমার জানা নেই। ১) পূজনীয়, প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিকে পূজা না করা ও সম্মান এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করার সংস্কৃতি। ২) বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার পর অহমিকা ও ঔদ্ধত্য বেড়ে যাওয়া। ইংরেজি জ্ঞানে পারঙ্গম হলে তো তাদের ঔদ্ধত্য ও অহমিতার কোনো সীমা-পরিসীমা মাপা যায় না। আদিবাসীরা মদ খেয়ে মাতাল হলে একজন অশিক্ষিত ব্যক্তিও ইংরেজি বলতে পারে। ৩) কলুষতাপূর্ণ দ্বিধাবিভক্ত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলসমূহের দখলবাজি, চাঁদাবাজি, আধিপত্যবাদী, চিন্তা-ভাবনা, গুমবাজি, অপহরণপূর্বক মুক্তিপণ আদায়, শত্রুতা উদ্ধারের জন্য কুৎসা রটনা ও মিথ্যা অভিযোগ দায়েরপূর্বক অনভিপ্রেত হয়রানিকরণ, দলীয়করণ, মাস্তানবাজি প্রভৃতি। ৪) অকৃতজ্ঞতা, কৃতঘ্নতা-এই দুটি বদগুণের চরম বহিঃপ্রকাশ মোনঘরের অতিরিক্ত সুবিধাভোগী আমার দ্বারা আমারই তত্ত্বাবধানে আমার থেকে ভালো-ভালো বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে বের হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রিধারী কমপক্ষে দশ/বারো জন মোনঘরের ফসল ছাত্রের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে এ বদগুণগুলো পরিলক্ষিত হয়েছিল, যা শুধু আমার প্রতি তাদের জীঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থকরণের কারণে এরূপ অকৃতজ্ঞ ও কৃতঘ্ন হয়েছিল, না-কি ‘যার বীর্যতার পরাক্রম’ এরূপ বংশানুক্রমিক জিনগত সমস্যার কারণে হয়েছিল-তা আমার মতো অর্বাচীন ভিক্ষুর পক্ষে উঢ়িষড়ৎব করা সম্ভব হয় নি। তবে মোনঘরের সব ফসলের মধ্যে তথা ৮০% শতাংশ ফসলের মধ্যে এর ব্যত্যয়ও পরিলক্ষিত হয়েছিল এবং তা দীপ্যমান। ৫) হিংসা, অনৈক্য, সংশয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ এখন আদিবাসী সমাজের মধ্যকার শুদ্ধ-শুভ সংস্কৃতি, মানব কল্যাণকর উন্নয়ন ভাবনা, অনাথ, অসহায়, ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের ‘মোনঘরে’র মতো বিদ্যায়তন তৈরি করে তথায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসনের ব্যবস্থা করা সরকারি পর্যায়ে না হলে ব্যক্তি অথবা সামষ্টিক পর্যায়ে চালু ও পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্বসূরিকে ছলে-বলে কৌশলে তার গোটা জীবনের তিল-তিল রক্ত ও স্বেদবিন্দু দিয়ে গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে উত্তরসূরিদের ক্ষমতারোহণের সংস্কৃতি, কাউকে ল্যাং মেরে ফেলে-দেয়ার সংস্কৃতি, অপরের উন্নতিতে প্রশংসিত করা বা বাহ্বা দেয়ার সংস্কৃতির অভাব (এই বদগুণের নাম পরশ্রীকাতরতা কি-না আমার অজানা), লাগামহীন স্বার্থপরতা, লাগামহীন স্বজনপ্রীতি, দলতান্ত্রিকতা, গোষ্ঠিতান্ত্রিকতা, আঞ্চলিকতাবাদ, অপরকে পদদলিত করে নিজেকে উচ্চে তুলে ধরার সংস্কৃতি, মদসহ যত ধরনের মাদক রয়েছে-তাতে আসক্ত হওয়ার সংস্কৃতি, জুয়াখেলা প্রীতি প্রভৃতি বদসংস্কৃতি আদিবাসী সমাজে এখন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে বলে আমার দৃঢ় ধারণা। এসব বদগুণসমূহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির বেলায় বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠী ওপরে উল্লিখিত বদগুণসমূহের উর্ধ্বে উঠে অহিংসা, মৈত্রী, মুদিতা, অপরের উন্নতিতে বাহ্বা প্রদানের যোগ্যতা) ও উপেক্ষা তথা সমচিত্ততার ভাবনায় ও অনুধ্যানে বিম-িত হতে না পারলে পারস্পরিক কলহ বিবাদে, দলাদলির কারণে, শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার অভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা অমূলক নয়। অথবা তারা অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে একটি মহা সমাজের ¯্রােতে অবগাহন করে সম্পূর্ণ মিশে যেতে পারে মহাকালের অমোঘ নিয়মে। এতে করে তারা হয়ত জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে তাদের স্থান পাকাপোক্ত করতে পারে।
মিল্টন বিশ্বাস: ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৌদ্ধ ভিক্ষুর জন্য কোনটি জরুরি ছিল-আধ্যাত্মিকতা চর্চা না-কি শিক্ষা বিস্তার?
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: আমি একজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভিক্ষু এটি আমি নীতিগতভাবে মানি না। ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষা নিলে তাকে কোনো জাত-বিচারের নিরিখে বিধৃতকরণকে আমি বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের চরম অপমান বলে মনে করি। বুদ্ধ জাতিভেদ প্রথা মানেন নি। তাঁর কুম্বুকন্ঠের উচ্চারণ হলো, জন্মসূত্রে কেউ ব্রাক্ষণ হয় না। জন্মসূত্রে কেউ চ-ালও হয় না। মানুষ চ-াল অথবা ব্রাক্ষণ আখ্যাপ্রাপ্ত হয় তাদের স্ব-স্ব কর্মসূত্রে। বুদ্ধের ধর্ম জ্ঞানীর ধর্ম। এটি অবিদ্যাচ্ছন্ন মূর্খদের ধর্ম নয়। প্রকারন্তরে ‘বুদ্ধ’ শব্দের অর্থই হলো জ্ঞান। বুদ্ধেুর এই মহান ধর্ম গম্ভীর, প-িত বেদনীয়, মহাসত্যনির্ভর ধর্ম। একাগ্র চিত্তে শ্রবণ, অন্তরের অন্তস্তলে শ্রদ্ধাসহগতচিত্তে ধারণ ও ধারণকৃত ধর্ম নিয়মনিষ্ঠভাবে যাপিত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অক্ষরে-অক্ষরে প্রতিপালনের মধ্য দিয়েই বুদ্ধধর্মের সার্থকতা। একজন যথার্থ শিক্ষিত, জ্ঞানী, ভাবিতচিত্ত, বহুশ্রুত ব্যক্তি না হলে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের আস্বাদ গ্রহণ করা কঠিন। একজন অশিক্ষিত, গ-মূর্খ, কূপম-ক, পরচর্চা, পরনিন্দা, পরের ছিদ্রান্বেষণে তৎপর ব্যক্তি অথবা ভিক্ষুর দ্বারা বুদ্ধের ধর্মদর্শনের যথার্থ আস্বাদ গ্রহণপূর্বক সমাজে মানবতা, জনকল্যাণের, মানবমুক্তির, জাগতিক দুঃখমুক্তির, বহুশ্রুত তৈরিকরণের সুবাতাস বইয়ে দেয়া বা বাতাবরণ সৃষ্টি করা সর্বোতভাবে অসম্ভব অথবা দিবাস্বপ্ন। আমার পরমারাধ্য গুরু জ্ঞানশ্রী মহাথেরো মহোদয় ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’টি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে আমার মতো আট-দশজন শিক্ষিত ভিক্ষু তৈরি করার পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার মহত্ত্ব দেখিয়েছিলেন বলেই আদিবাসী সমাজ ‘মোনঘর’, ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’ কলকাতার ‘বোধিচরিয় সিনিয়র সেকেন্ডারী স্কুল’, ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের কার্যক্রম অবলোকন করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। শিক্ষিত, দূরদর্শী, করিৎকর্মা বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী উচ্চশিক্ষিত ভিক্ষু যদি তৈরি না হতো, তাহলে ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তৈরি অথবা একদল অশিক্ষিত গ-মূর্খ ভিক্ষু অথবা ভিক্ষুসংঘের দ্বারা অসম্ভব ও অবিশ^াস্য নয় কি? তাই বুদ্ধের চিরন্তন উচ্চারণ হলো, ‘তোমরা বহুশ্রুত হও, বহুবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করো, প্রতিনিয়ত অন্যকে সুভাষিত বাক্যের দ্বারা প্রণোদিত করো; এতে করে তোমরা সদাসর্বদা সর্বক্ষেত্রে মঙ্গল ও অপ্রমেয় কল্যাণ দর্শন করবে।’ মঙ্গলসূত্র।
আধ্যাত্মিকতা চর্চার মধ্য দিয়ে চিরশান্তিময় নির্বাণ লাভ করার ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত উচ্চারণ হলো এখন ২৫৫৯ বুদ্ধাব্দ চলছে। তার মানে ২৫৫৯ বছর আগে মানবপুত্র বুদ্ধ তাঁর দুঃখ মুক্তির ধর্মপ্রচার করেছিলেন। গ্রন্থধুর ও বিদর্শনধুর প্রতিষ্ঠা করে তাঁর সংঘ সমাজ পরিচালনা করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। বুদ্ধের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ‘বিদর্শন ধুর’পন্থি ভিক্ষুরা কঠিন কঠোর Insight meditation চর্চার মধ্য দিয়ে বুদ্ধের মতো মহাসত্যের আস্বাদ পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন ও দুঃখের অন্তঃসাধন করেছিলেন। বর্তমান সময়ে বুদ্ধের সেই মহান ধর্ম-দর্শনের ছিটেফোঁটাও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান রয়েছে কি-না সন্দেহ। যদি থাকত, বর্তমান সময়ের স্বঘোষিত অর্হৎ ও সাধকগণ পরচর্চা, পরনিন্দা, পর ছিদ্রান্বেষণে কালক্ষেপণ না করে আত্মচর্চা, আত্ম অন্বেষণ, আত্মসমীক্ষার মধ্য দিয়ে আত্ম শুদ্ধির পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার কারিশমা দেখাতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘গ্রন্থধুর বা ধর্মকথিক’ আদর্শে বিশ^াসী একজন অর্বাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষু হিেেসবে আমি বিশ^বিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে আধ্যাত্মিকতা চর্চার পরিবর্তে শিক্ষা বিস্তারে নিজেকে ব্যাপৃত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ধ্যানচর্চার ক্ষেত্রে নির্মোহ, নির্ভিক ভাবিত চিত্ত ধ্যানগুরুর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বিধায় বর্তমান নকলনবিশ, ধান্ধাবাজ, মতলববাজ, অহমিকায় পরিপূর্ণ স্বঘোষিত অর্হৎ ভ- তপস্বীদের সান্নিধ্যে গিয়ে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বর্গ, মোক্ষ, নির্বাণের ট্যাবলেট গলাধঃকরণ করিয়ে সাধারণ সহজ, সরল ধর্মভীরু জনসাধারণের পকেট খালি করার অপতৎপরতায় লিপ্ত হতে আমার মন সেদিকে ধাবিত হতে দেয় নি।
মিল্টন বিশ্বাস: বর্তমানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ বেশ শিক্ষিত। এই শিক্ষিতরা দেশ-জাতির কল্যাণে কতটুকু এবং কীভাবে নিবেদিত?
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষিত আদিবাসী জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বাংলাদেশের ৬১টি জেলায় কোনো ধরনের দায়িত্বপূর্ণ কাজে অধিষ্ঠিত হলে-সেটি সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি অথবা এনজিও সেক্টরে হোক, তারা সেখানে যথাসাধ্য অবদান রাখার চেষ্টায় আত্মনিবেদিত থাকেন। তারা ঘুষ কেলেঙ্কারিসহ নানাবিধ অবৈধ কর্মকা-ে জড়িত হয়ে কোনো প্রকার পত্র-পত্রিকায় শিরোনাম হওয়ার প্রয়াস দেখান নি। তবে তারা সকলেই যে গঙ্গাজলে ধৌত করা ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা তুলসি পাতা-তা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে তারা যে একেবারে পুকুর চুরি করবে না-তা স্বতঃসিদ্ধ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত, চিন্তা-চেতনায় প্রাগ্রসর, সম্পদের সম্ভাবনা সন্ধানে দক্ষ প্রশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ তিন পার্বত্য জেলার অভ্যন্তরে দৃশ্যমান কোনো অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছেন না। তার কারণ বহুমাত্রিক। এসব কারণ হলো, রাজনৈতিক অস্থিরতাসম্ভূত অনিশ্চয়তা, ত্রিধা বিভক্ত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর পৌনঃপুনিক চাঁদাবাজি, সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান, জনকল্যাণে আত্ম নিবেদিত প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠানসমূহকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নিজ-নিজ প্রভাব বলয়ের নিয়ন্ত্রণে রেখে ‘যে হংস স্বর্ণ ডিম্ব প্রসব করে’ এমনই অবস্থায় রেখে প্রয়োজনে অথবা অপ্রয়োজনে অথবা মর্জিমাফিক অর্থ আদায়ের পথ সুপ্রশস্ত করে রাখা, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কলুষিত রাজনীতির প্রভাব বলয় সৃজন করে সুকৌশলে রাজনীতির ময়দানে টেনে এনে তাদের শিক্ষা জীবনের বারোটা বাজিয়ে দেয়া, কেউ যদি শতভাগ রাজনীতি নিরপেক্ষতা, দল নিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নিরপেক্ষতা, আঞ্চলিকতাবাদ নিরপেক্ষ মনোবৃত্তি উৎসর্জনের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে বদ্ধ পরিকর হন-তাকে/তাদেরকে ছলে-বলে-কৌশলে রাজনীতির রঙে রঞ্জিত করে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করা প্রভৃতি চ্যালেঞ্জের কারণে পাহাড়ি শিক্ষিতরা পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে দেশ ও জাতির কল্যাণে কোনো দৃশ্যমান অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছেন না।
মিল্টন বিশ্বাস: পার্বত্য চট্টগ্রাম না-কি ঢাকা অথবা অন্য সমতলে আপনার শিক্ষা বিস্তার ঘটেছে? কেন ঘটিয়েছেন? শহরে তো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে?
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: আমি আমার অগ্রজ বিমল ভান্তে, অনুজ শ্রদ্ধালংকার, প্রিয়তিষ্য ও জিনপাল এই পাঁচজন ভিক্ষু ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’, ‘মোনঘর’, ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ ও ঢাকায় ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মধ্য দিয়ে তিন পার্বত্য জেলার দশ ভাষাভাষী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অনাথ, অসহায়, ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র সন্তান-সন্ততিদেরকে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসনের উপযোগ সৃষ্টি করে বর্ণিত অনাথ আশ্রমসমূহে দিয়ে কমপক্ষে দেড় সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে নিবিড় শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালনা করে এসেছি। এছাড়াও ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ‘মোনঘরে’র অর্থায়নে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া গরিব অথচ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মাসিক ভিত্তিতে স্কলারশিপ প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। তা ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এতদসঙ্গে বাঘাইছড়ি উপজেলার ‘কাঁচালং শিশু সদন’, খাগড়াছড়ি জেলার ‘গিরিফুল শিশু সদন’ ও বান্দরবান জেলার ‘বান্দরবান বৌদ্ধ অরফানেজ’, ‘মোনঘরে’র অর্থায়নের আওতাধীনে এনে ওই চারটি অনাথ আশ্রমের ছয়শ অনাথ শিশুর খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ, পথ্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও আবাসন খরচ নির্বাহ করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তেরো বছর আমার শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম তিন পার্বত্য জেলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দিঘীনালা উপজেলার সুপ্রাচীন ও সুপ্রসিদ্ধ অনাথ আশ্রম ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’টি বাঙালি নতুন বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে ঢাকাস্থ পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক আমার অগ্রজ ভদন্ত বিমল ভিক্ষু অন্যদেশে পালিয়ে গেলে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের দায়িত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার কাঁধে এসে বর্তায়। পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের স্থাপনায় আমি ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ চালু করি। বনফুল প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দুইশ আট জন অনাথ, অসহায়, ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র সন্তানসন্ততিকে আশ্রয় দিয়ে তাদের শক্তপোক্ত প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করি। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। সমৃদ্ধ বাঙালি জনগোষ্ঠীর বর্ণাঢ্য চিন্তা-চেতনার অধিকারী সবচেয়ে প্রশিক্ষিত মহামনীষীরা এই রাজধানী ঢাকাতেই অবস্থান করেন। জাতীয় পর্যায়ের সকল অফিস-আদালত এই রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। বলা যায়, ‘ক্রিম অফ দ্য বাঙালি সোসাইটি’ এই ঢাকা শহরের বুকেই অবস্থান করেন। ঢাকা শহরের বুকে গড়ে-ওঠা মানসম্মত স্কুল, কলেজসমূহে বিষয়ভিত্তিক দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকা পাওয়া খুবই সহজ। এই বিষয়টি সবিশেষ মূল্যায়ন করে আমি মিরপুর-১৩’র শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের বনফুল কমপ্লেক্সে সর্বপ্রথম ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ প্রতিষ্ঠা করি এবং যুগপৎভাবে ‘বনফুল প্রাইমারী স্কুল’ চালু করে দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত ছয় জন শিক্ষিকা নিয়োগ প্রদান করে নিবিড়ভাবে আশ্রিত ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাথমিক শিক্ষায় সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করি। ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’ ও ‘বনফুল প্রাইমারী স্কুলটি ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নিবিড় পাঠদান প্রক্রিয়া চালু রেখেছিল। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা তাদের অর্থসংস্থান কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে ২০৮ জন ছাত্র-ছাত্রী রাঙ্গামাটির ‘মোনঘরে’ গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই পর্যন্ত পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের এ সুরম্য স্থাপনাটি খালি, অবহেলিত ও অনাদৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আমি তৃতীয়বার ‘পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘে’র কার্যনির্বাহি পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হলে পার্বত্য বৌদ্ধ আমি প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোসহ সাত জন সদস্য-সদস্যার সম্মিলনে ‘বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট’ গঠন করি। মিরপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ট্রাস্ট্রের নিবন্ধন গ্রহণ করে ট্রাস্ট্র কর্তৃক ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার কার্যক্রম হাতে নিই। ট্রাস্ট্রের সমন্বিত সিদ্ধান্ত হলো যে, কলেজটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, পাহাড়ি ও বাঙালি নির্বিশেষে সকল ধর্মাবলম্বী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এখানে দেড় শতাধিক পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর খুবই মেধাবী সন্তান-সন্ততি আবাসিকভাবে অবস্থান করে। এ কলেজের সমৃদ্ধ বাঙালি জনগোষ্ঠীর দুই সহস্রাধিক সন্তানসন্ততির সাথে প্রতিযোগিতার মনোবৃত্তি উৎসর্জনের মধ্য দিয়ে নিবিড়ভাবে পড়ালেখায় নিরত থেকে তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখবে। কলেজে দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দ্বারা মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করা হবে। প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে ভর্তি ফি ও মাসিক টিউশন ফি প্রদান করতে হবে। এই কলেজটি করার পেছনে আমার আরো একটি অন্তর্গূঢ় বাসনা ক্রিয়াশীল ছিল-তা হলো পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর সন্তানসন্ততিদের মধ্যে দীর্ঘ বারো বছরের পারস্পরিক Interaction-এর মধ্য দিয়ে নিবিড় পড়ালেখায় নিরত থাকার অনুষঙ্গে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সুদৃঢ় অন্তরঙ্গতা উৎসর্জনের মাধ্যমে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বিরাজমান অবিশ্বাসের আবহ বিদূরিতকরণ। খুবই সীমিত পরিসরে হলেও আমার এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন আদৌ হবে কি-না তা অবশ্য ভবিতব্যই জানে। তবে এ কলেজটি চালু ও পরিচালনার সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থাকার দরুন কলেজে কর্মরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে আমার প্রতি তাঁদের বিশ্বাসের অন্তরঙ্গতা উপলব্ধি করার অবকাশ ইতোমধ্যেই পেয়েছি। আমার মধ্যে অন্তর্গূঢ় একটি চ্যালেঞ্জ সদাসর্বদা প্রতিজ্ঞার মতো দীপ্যমান ছিল খ্রিষ্টান ধর্মজগতের বহুশ্রুত ধর্মযাজক সম্প্রদায় ঢাকা শহরের বুকে ১৩/১৪টি সর্বজন গ্রহণযোগ্য মানসম্মত স্কুল -কলেজ যদি চালাতে সক্ষম হন, আমি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে’র মতো একটি কলেজকে কেন মানসম্মতভাবে চালাতে বা পরিচালনা করতে পারবো না? আমি দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’, ‘মোনঘর’ পরিচালনা করে যতটুকু বাস্তব অভিজ্ঞায় ঋদ্ধ হয়েছিলাম-এখানে এই ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’টিতে দীর্ঘ দশ বছর পরিচালনা পর্ষদে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থাকার অনুষঙ্গে আমি মনে করি আমার অভিজ্ঞতার ভা-ার, মানুষ চেনার পরিধি, মানুষকে স্বমতে নিয়ে আসার কর্মকৌশল আরো সমৃদ্ধ ও সুবিস্তৃত হয়েছে। বলা যায়, নিজের কর্মদক্ষতার পরিধি, নিজেকে চেনার জন্য, নিজের যোগ্যতাকে বৃহত্তর পরিসরে যাচাই করার লক্ষ্যে, নিজেই আমি রাজধানী ঢাকা শহরের বুকে ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’টি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কতটুকু সফলতা পেয়েছি-তা কালের ইতিহাস মূল্যায়ন করবে।
মিল্টন বিশ্বাস: বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতাগুলো কী-কী? সুন্দর প্রতিষ্ঠান গড়তে কেমন শিক্ষক-শিক্ষার্থী চান?
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে ‘পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’, ‘মোনঘর’-এ দুটি অনাথ আশ্রম এবং এই দুটি অনাথ আশ্রমকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে গিয়ে যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলাম, রাজধানী ঢাকার বুকে মিরপুর-১৩-তে শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারের বনফুল কমপ্লেক্সে ‘বনফুল চিলড্রেন্স হোমস’, ‘বনফুল প্রাইমারী স্কুল’ এবং দুটি প্রতিষ্ঠানের পরিণত রূপ ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ’ ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের গুটিকয়েক প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তির অসহযোগিতা ছাড়া তেমন বড় ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হই নি। ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী আমার সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষাভবন আমার কাজে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে নি। বলতে গেলে সদাশয় সরকারের উঁচু মহলের সহৃদয় সহযোগিতায় আমার ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই তারিখে কলেজ শুরুর কাজটি নির্বিঘেœ ও সফলতার সাথে ফলপ্রসূ হয়েছে। মাত্র এগারো জন কলেজ পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীকে পুঁজি করে কলেজটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে স্কুল পর্যায়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তি করার অনুমতি ঢাকা শিক্ষাবোর্ড প্রদান করার পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলে প্লে-নার্সারি শ্রেণি থেকে শুরু করে নবম শ্রেণি পর্যন্ত এগারো শত ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করাতে সক্ষম হই। এক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার মিরপুর-১৩’র পার্শ্ববর্তী চিন্তাশীল, বিচক্ষণ ও শিক্ষানুরাগী মুসলিম জনগণ আমার মতো একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর উদ্যোগকে আস্থায় নিয়ে তাদের সন্তানসন্ততিদেরকে ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে’ ভর্তি করিয়ে দিয়ে আমাকে সম্মানিত ও প্রণোদিত করার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। আমি, আমার কলেজ পরিচালনা পর্ষদ, নিয়োগপ্রাপ্ত সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকামন্ডলী সম্মানিত অভিভাবক-অভিভাবিকাদের কাছে প্রদত্ত Commitment বা প্রতিশ্রুতি দশ বছরের ব্যাপ্তিকালে পর্যায়ক্রমে ৯০% শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বিগত ছয় বছর ধরে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় শতভাগ পাশ করেছে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ হতে শতভাগ জিপিএ পাওয়ার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি।
একটি সর্বাঙ্গ সুন্দর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সর্বাগ্রে দরকার দক্ষ, প্রশিক্ষিত, প্রজন্ম বিনির্মাণে আত্মনিবেদিত প্রাণ, ত্যাগময় দীক্ষায় দীক্ষিত, নব-নব সৃজনী প্রতিভার অধিকারী, বাস্তবায়ন কর্ম-কৌশলে পারঙ্গম, নীতিবান, নির্মোহ চরিত্রের একজন Principal বা অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষ মহোদয়ের নীতি নিয়মনিষ্ঠ সময়ানুগ দিক-নির্দেশনা, তার কথাবার্তা, চালচলন, আচার-আচরণ, মন-মনন হওয়া উচিত সহকর্মী শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দের প্রাণময় অনুপ্রেরণার উৎস। পাঠোন্নয়ন পাঠদান প্রক্রিয়ায় দায়বদ্ধ দায়িত্ব প্রতিপালনের অনুষঙ্গে আত্মোৎসর্গীকৃত শক্তিমত্তায় বিশ্বাসী শিক্ষক-শিক্ষিকা তৈরিকরণই অধ্যক্ষ মহোদয়ের প্রধান কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। বস্তুত অধ্যক্ষ মহোদয়ই হবেন সেই কলেজের প্রাণশক্তি, চালিকা শক্তি, কলেজ পরীক্ষণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু । তাঁকে ঘিরেই নিজ-নিজ কক্ষপথে শিক্ষক-শিক্ষিকারা ঘুরবেন, অবদান রাখবেন, প্রশিক্ষিত হবেন, সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখবেন, আত্মগতভাবে পাঠদান দেবেন, সৃজনশীল পাঠদানের মধ্য দিয়ে স্ব-স্ব বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ঔৎসুক্যপরায়ণতার স্ফুরণ ঘটাবেন, ছাত্র-ছাত্রীদেরকে হাতে-কলমে শিক্ষা দেবেন, বিনয়, নীতি, আদর্শ, ভক্তি, শ্রদ্ধা, যথালাভে সন্তুষ্ট থাকার কর্ম-কৌশল শিক্ষা দেবেন, দেশপ্রেমের অঙ্গীকারে অঙ্গীকারবদ্ধ করবেন এবং এভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হলে সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দেশদরদি, মানবদরদি, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় বিশ^াসী, বিশে^র সার্বিক কল্যাণকামী আর্শীবাদপুষ্ট সুনাগরিক গড়ে উঠবে-তা স্বতঃসিদ্ধ। শিক্ষক-শিক্ষিকাম-লী পূর্ব বর্ণিত চরিত্রের অধিকারী হলে শিক্ষার্থীগণও নির্মল চরিত্রের অধিকারী হবে-তা বলাই বাহুল্য।
মিল্টন বিশ্বাস: শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসারে আপনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সুবিধা হচ্ছে কি? শিক্ষানীতিতে কোনো নতুনত্ব থাকলে সে-বিষয়ে কিছু বলুন?
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে আমি এ যাবৎ কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হই নি। বরং প্রজেক্টরের মাধ্যমে বাস্তবসম্মতভাবে অংশগ্রহণমূলক পাঠদানের উৎকর্ষ বিধানের জন্য সদাশয় সরকার এ কলেজকে দুটি প্রজেক্টটর বিনামূল্যে প্রদান করার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। ২০১০ শিক্ষানীতি সম্পর্কে নতুনত্ব খোঁজার পারঙ্গমতা আমার নেই।
মিল্টন বিশ্বাস: একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে-তোলার জন্য বর্তমান বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলো কী-কী?
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে তার পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিবেশ, ধর্মীয় পরিবেশ, বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিবেশ ভাবনা থেকে নিজেকে নির্লিপ্ত রাখা বর্তমান সময়ের নিরিখে খুবই কঠিন। বিজ্ঞানের অভাবিত উন্নতির বদৌলতে মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে ফেসবুক, টুইটার, ই-মেইল, ওয়াইফাই প্রভৃতির কল্যাণে গোটা বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। তাই বর্তমান বিশ্বে একজন শিক্ষার্থীকে যথার্থভাবে নৈতিক ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে নিম্ন বর্ণিত চ্যালেঞ্জসমূহ গভীরভাবে মূল্যায়নপূর্বক আশু সতর্কতা অবলম্বন করার দরকার রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়মনিষ্ঠ কাউন্সেলিং-এর আওতায় এনে বর্ণিত চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে বাস্তবসম্মত, জীবনঘনিষ্ঠ, আত্মগত, নীতি নৈতিকতাসম্মত পাঠ্যক্রম না সাজালে মারাত্মক হুমকি অনিবার্য। ক) সাম্প্রদায়িক সম্পৃক্ততা উগ্র মৌলবাদ চ্যালেঞ্জ। খ) মোবাইল ফোনের দ্বারা চরিত্র-ভ্রষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনাপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। গ) কলুষিত রাজনৈতিক বলয়ভুক্ত হওয়ার তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে অবৈধপথে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার চ্যালেঞ্জ। ঘ) অবৈধপথে মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ার দরুন ছাত্র-ছাত্রীদের মাদকাসক্ত হওয়ার চ্যালেঞ্জ ঙ) প্রাণিবাণিজ্য, অস্ত্রবাণিজ্য, মাংসবাণিজ্য, বিষবাণিজ্য ও মাদকবাণিজ্যের কারণে অতি সহসা ধনী হওয়ার অবকাশ থাকায় তাতে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে ওই সব বাণিজ্যসম্পৃক্ত হওয়ার চ্যালেঞ্জ। চ) পরিবারই শিশুদের প্রথম পাঠশালা। মাতা-পিতার নিষ্কলুষ আচরণ, নিষ্কলুষ কথাবার্তা, নিষ্কলুষ চিন্তা-ভাবনা তাড়িত কর্ম-সংস্কৃতি তথা পারিবারিক কর্মসংস্কৃতি একটি শিশুর অন্তরে প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ, মূল্যবোধ, সংস্কৃতিবোধ, মানবতাবোধ, সহিষ্ণুতাবোধ, সহমর্মিতাবোধ পরমত সহিষ্ণুতাবোধ, পারস্পরিক সমন্বয় বোধ, শৃঙ্খলাবোধ, জীবনের সর্বক্ষেত্রে দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ জাগ্রত করে দেয়ার অবকাশ দিতে পারে। কিন্তু দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পিতা-মাতার সান্নিধ্য ও অবৈধ কর্মসংস্কৃতির আবহ সন্তানসন্ততিদের অন্তরে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এতে সন্তানসন্ততিদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটতে পারে। বহুল আলোচিত পিতামাতা হন্তারক সতেরো বছরের ঐশী তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ। ছ) রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অস্থিরতার দরুন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টিতে চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হওয়ার কারণে মেধা পাচার হয়ে যাওয়ার তাগিদ অনুভূত হওয়ার চ্যালেঞ্জ। জ) উচ্চতর বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ছাত্র রাজনীতির দলাদলিতে সেশন জটের কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাজীবনসহ তাদের গোটা জীবনের স্বপ্ন সম্ভাবনা ধ্বংস হওয়ার চ্যালেঞ্জ। ঋ) অহিংসার পরিবর্তে সহিংস পদ্ধতিতে শত্রুতা উদ্ধারের চ্যালেঞ্জ। ঞ) ‘চোখের বদলে চোখ’, ‘নাকের বদলে নাক’, ‘রক্তের বদলে রক্ত’-এরূপ সহিংসতার সংস্কৃতি লাগামহীনভাবে বেড়ে-যাওয়ার কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে চরমতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। গোটা বিশ্বের ছাত্র-ছাত্রীদের চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে কোনো কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই।
মিল্টন বিশ্বাস: দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হলে কী করবেন?
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: আমি একজন খুবই নগণ্য বহুনন্দিত ও বহুনিন্দিত বৌদ্ধ ভিক্ষু সমৃদ্ধ বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে আমি অনেকাংশে নন্দিত হলেও ১০% শতাংশ আদিবাসী চাকমা জনগোষ্ঠীর কাছে আমি নিন্দিত ও অগ্রহণযোগ্য একজন অর্বাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষু। চাকমা আদিবাসী সমাজে ভবিষ্যতে আমি মারা গেলে আমার জন্য কান্না করার লোক ভাড়া করতে হবে বলে আমার ধারণা। মোনঘরের অর্থায়নে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত অতিশয় সুবিধাভোগী আদম সন্তানরা যেহেতু আমার ওপর থেকে স্বজ্ঞানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সেহেতু দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে’র শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হলে রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারে গিয়ে জীবনের শেষ মৃত্যুক্ষণের জন্য অপেক্ষার প্রহর গণনা করা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই।
মিল্টন বিশ্বাস: ভালো স্কুল-কলেজ কিংবা মেধাবী শিক্ষার্থী বলতে আপনি কী বোঝেন?
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: আমার দৃষ্টিতে ভালো স্কুল বা কলেজের সংজ্ঞাটি হলো-ক) যে স্কুল অথবা কলেজটি যেনতেন প্রকারণে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়ার আত্যন্তিক অপতৎপরতার পরিবর্তে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন দক্ষতা উৎসর্জনের তাগিদে মেধা ও মননের সম্মিলিত সমন্বয় সাধনপূর্বক কর্মজীবনের সর্বক্ষেত্রে নিজ-নিজ অবস্থান সুসংহত ও সুদৃঢ় করার কারিশমা সম্বলিত প্রতিশ্রুতিশীল প্রজন্ম তৈরি করতে অবদান রাখবে-সেটিই আমার দৃষ্টিতে ভালো স্কুল ও ভালো কলেজ। ভালো শিক্ষার্থীর সংজ্ঞাটি হলো, যে ছাত্র-ছাত্রীটি মেধা ও ধীশক্তিতে অনন্য সাধারণ ও নৈতিক শক্তিতে শক্তিমান-সেই ছাত্র অথবা ছাত্রীটিই হলো আমার দৃষ্টিতে ভালো ছাত্র। একজন ভালো ছাত্র বা ভালো ছাত্রীর জন্য কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় ঋদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। নীতি নৈতিকতাহীন ছাত্র বা ছাত্রী অসম্ভব মেধাসম্পন্ন হলেও বাস্তব জীবনে আত্মঘাতী, মানববিধ্বংসী, সভ্যতাবিধ্বংসী, অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হতে পারে। তাই যে কলেজ অথবা স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নীতি-নৈতিকতাবোধ শিক্ষা দেবে, ত্যাগী, দয়াবান, হৃদয়বান, মরমী, মানবিক, পরোপকারী, দেশপ্রেমিক, আত্মপ্রত্যয়ী, দায়িত্ববান, কর্তব্যপরায়ণ, অজ্ঞানীর অসংস্পর্শ, জ্ঞানী প-িতের সংস্পর্শ, পূজনীয় ব্যক্তির পূজার্চনা, বহুশ্রুত হওয়ার পরামর্শ, বহু শিল্পবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে উপযোগ সৃষ্টি করে দেবে সেই স্কুলটিই আমার দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ স্কুল অথবা কলেজ। বর্ণিত সদগুণসমূহের সম্মিলিত সমাহারই একজন ভালো ছাত্র অথবা ভালো ছাত্রীর সংজ্ঞা বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
মিল্টন বিশ্বাস: আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকারের গৃহীত শিক্ষা কার্যক্রম কেমন? তারা কি সকল ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে?
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: আমার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকারের দ্বারা শিক্ষা কার্যক্রম পূর্বের চাইতে অনেক ভালো। বর্তমান সরকার শিক্ষা বিস্তারকে সর্বত্রগামী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে লক্ষ-লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীকে বিনামূল্যে বই বিতরণ করছেন। নারী শিক্ষাকে পুরুষের সম-পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে তাবৎ বালিকাদেরকে উপ-বৃত্তির আওতায় এনে তাদের জন্য নিবিড় পড়ালেখার আবহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। হাতে-কলমে শিক্ষাদানের জন্য মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম চালু করার উদ্দেশ্যে প্রতিটি স্কুল ও কলেজে প্রজেক্টর সরবরাহ করার প্রয়াস পাচ্ছেন। প্রতিটি স্কুল এবং কলেজকে কম্পিউটার শিক্ষার জন্য কম্পিউটার সরবরাহ করছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকে প্রতিনিয়ত সৃজনশীল পাঠদান কার্যক্রমকে গতিশীল, বাস্তবানুগ, আকর্ষণীয় করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের আওতায় এনে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে চলেছেন। ভর্তি বাণিজ্য থেকে মুক্তির জন্য অন-লাইন ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করেছেন। (তবে একটি দেশে দুটি ভর্তি প্রক্রিয়া চালু রাখা দুর্ভাগ্যজনক।) সরকারের এই শিক্ষা কার্যক্রম আমার দৃষ্টিতে খুবই ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়। শিক্ষা কার্যক্রমে সরকারের সফলতা-বিফলতা নিরূপণ করার যোগ্যতা আমার নেই। তবে অনলাইন ভর্তির ব্যাপারে অদক্ষতা, সমন্বয়হীনতা, সময় ক্ষেপণ, সাধারণ জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। এসব অনাকাক্ষিত,অতি উৎসাহী উদ্যোগ ও তৎপরতার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি বলে আমি মনে করি।
মিল্টন বিশ্বাস: শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও স্বপ্নের কথা বলুন।
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’-শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমার ব্যক্তিগত চাওয়াটাও তাই। আমি অনাথ সন্তান ছিলাম। আমার গুরু পরমপূজ্য জ্ঞানশ্রী মহাথেরো আমাকে অনাথ আশ্রমে স্থান দিয়ে তাঁরই পবিত্র সান্নিধ্যে রেখে অনাথ আশ্রমের অর্থায়নে আমাকে পড়িয়েছেন। অনাথ শিশুদের কী দুঃখ, কী মর্মযাতনা-তা আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম। অনেক দুঃখ, অনেক কষ্ট, অনেক অবহেলা, অনাদর, অনেক তির্যক মন্তব্য, অনেক ঘৃণা, অনেক না পাওয়ার বেদনাকে বুকে চেপে রেখে তিল-তিল রক্ত ও স্বেদবিন্দু ত্যাগ করে শুধুুমাত্র ধনুক ভাঙা পণকে পুঁজি করে শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় থেকে একেবারে বিশ^বিদ্যালয়ের উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত আমার একমাত্র ভালোবাসা ‘পড়ালেখা’ চালিয়ে এসেছিলাম। তা একমাত্র আমিই জানি আর জানে আমার ‘ভালোবাসা’। নবম শ্রেণির পাঠ্য বই সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও নোট বই ক্রয় করা সম্ভব হয় নি বিধায় সহপাঠীদের কাছ থেকে নোট বই ধার করে এনে দিন-রাতের অধিকাংশ সময় ওই নোট বই খাতায় লিখে-দু-একদিনের মধ্যে তা ফেরত দিতে হয়েছিল আমাকে। গুরু বলতেন ‘বিদ্যা অমূল্য ধন’। ‘ধন, রতœ, টাকা পয়সা চুরি হতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞার আলোকে প্রাপ্ত বিদ্যা কখনো কেউ চুরি করার অবকাশ পাবে না।’ বিদ্ধান ব্যক্তি, শিক্ষিত ব্যক্তি, বহুশ্রুত ব্যক্তি, বহুশিল্প বিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তি পৃথিবীর সর্বত্রই নিজ-নিজ অবস্থান সুসংহত করার যোগ্যতা রাখেন। এরূপ অনেক চিরন্তন উচ্চারণ ও শিক্ষা-ভাবনা আমার একেবারে অন্তরের গভীরে গুরুই সংক্রমিত করে দিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় আত্মগত ধ্যান-সাধনা নয়, আত্মগতভাবে শিক্ষা, শিক্ষা-বিস্তার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ভাবনা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ভাবনা আমার মনে শিকড় গাড়তে পারে নি আমার গোটা যাপিত জীবনে। তাই আমি ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট বিশ^বিদ্যালয়’ তৈরি করতে চাই।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সদাশয় সরকারের কাছ থেকে জমি চাই। এ কাজে সদাশয় সরকারের সহযোগিতা চাই। আমার অকৃত্রিম বন্ধু স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে এসব স্বপ্ন-সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করার পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা কামনা করি। আমার এই ৬৮ বছরের বয়োক্রমের জীবনে ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি এখন স্বপ্ন দেখি, পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের নামে ৯৯ বছরের জন্য লিজপ্রাপ্ত জায়গায় একটি দশ তলার সুরম্য দৃষ্টিনন্দন ইমারত নির্মানের। ওপরের পাঁচ তলায় শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারের অপরিহার্য অনুষঙ্গ করুণাঘন বুদ্ধের প্রতিমুর্তিটি সর্বোচ্চ দশ তলায় প্রতিস্থাপন করা হবে। তার নিচে ধ্যানকেন্দ্র; তার নিচে পাঠাগার থাকবে; আর তারও নিচে ভিক্ষু নিবাস স্থাপিত হবে। পঞ্চম তলায় অতিথিশালা ও শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারের অফিস স্থাপন করব। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় চারশ আদিবাসী মেধাবী সন্তানসন্ততিদের আবাসনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। ১ম তলায় একটি Multipurpose Hall নির্মাণ করব, যেখানে কলেজ ও শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারের সম্মেলনাদি অনুষ্ঠিত হবে। বেসমেন্টে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রাখব। ‘মানুষের আশা বাড়ে আর আয়ু কমে।’ আমার এ আশা-আকাঙ্কা, স্বপ্ন-সম্ভাবনা অপূর্ণই থেকে যাবে, যদি আমি তা করে যেতে না পারি। চার একর পরিমাণ খাস জমি পাওয়ার জন্য সদাশয় সরকারের কাছে দরবার করা হচ্ছে। যদি ওই পরিমাণ জমি সদাশয় সরকার বরাদ্দ দিয়ে আমাকে ও বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্টকে চিরকৃতার্থ করেন, তাহলে ট্রাস্ট কর্তৃক সেখানে ‘বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য সক্রিয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য বিশে^র নানা দেশের আমার শ্রদ্ধেয় মহামনীষীবর্গের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রাণপন প্রচেষ্টা চালাবো।
মিল্টন বিশ্বাস: আপনাকে ধন্যবাদ। ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো: আপনাকেও ধন্যবাদ।