পরচর্চা বনাম আত্মচর্চা, পর্ব- ০১
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো
বাংলা একাডেমী কর্তৃক মুদ্রিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে পরচর্চার অর্থ করা হয়েছে অন্যের সম্বন্ধে আলোচনা, পরনিন্দা, অপরের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা। একজন সত্যিকার মনুষ্যত্ববোধে ঋদ্ধ সংসার সমুদ্র পাড়ি দেওয়ায় লক্ষ্যে সংসার ত্যাগী বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেলায় সর্বতোভাবে বর্জনীয়। একজন সাধারণ মানুষও পারতপক্ষে পরচর্চার বশবর্তী হন না। একজন সাধারণ পৃথকজন পুদগল বা ব্যক্তি আর, একজন সংসার ত্যাগী মুক্তি প্রত্যাশী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে পরচর্চা সংক্রান্ত বিষয়টি তাদের স্ব স্ব মনে দ্বি-ভাবে অনুরক্তি সৃষ্টি করতে পারে। বর্তমান সময়ে হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে, প্রতিপক্ষকে জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে খুবই বাজে মানসিকতা সম্পন্ন একজন সাধারণ পৃথকজন ব্যক্তি বা পুদ্ গল পরচর্চা বা পরনিন্দার বশবর্তী হতে পারেন। ইদানিং রাজনীতিতেও একহাত দেখে নেয়ার অভিপ্রায়ে অথবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য পরচর্চার একটি বাজে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে-যা সুধী সমাজে তা খুবই নিন্দনীয়, হীন, জঘন্য, ইতরজনোচিত, অভদ্রজনোচিত বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।
মানুষ কথনো সর্বক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পন্ন নন। লোক সমাজে প্রচলিত প্রবাদ-’দোষে গুণে মানুষ’। লোকয়ত লৌকিক জীবনে কি ভিক্ষু কি সাধারণ গৃহী জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে নানা ধরণের কাজ, নানা শিল্প বিদ্যায় নিজেদেরকে ব্রতী করতে পারেন। তবে সংসার ত্যাগী ভিক্ষুদের বেলায় যেহেতু তাঁরা রং বস্ত্র ধারণ করে আগার থেকে অনাগারিক জীবন গ্রহণ করেন সেহেতু পরচর্চার পরিবর্তে আত্মচর্চা, আত্মঅন্বেষণ, আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে সর্বপ্রযত্ন আত্মনিবেদন থাকা জরুরী বলে করুণাঘন বুদ্ধের কঠোর দিক নির্দেশনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে করুণাঘন বুদ্ধের কম্বুকণ্ঠের উচ্চারণ হল-
‘অত্তদীপা বিহারথ অত্তসরণা অনঞ্ঞসরণা,
হে আনন্দ, তোমরা আত্মদীপ হয়ে বিহার কর। আত্মশরণ ও অনন্য শরণ হও।
তস্মা তিহানন্দ-‘দম্মদীপা ধম্মসরণা অনঞ্ঞসরণা’
আত্মশরণ ও অনন্য হয়ে ধম্মদীপ ধম্মশরণকে অনন্যশরণ রূপে জাগ্রত রেখে বিহার কর। বুদ্ধ আরো বলেছেন-
‘অত্তহি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরো সিযা?
অত্তনাব সুদন্তেন নাথং লভতি দুল্লভং।’
আপনা গোটা জীবনের আপনি আপনার ত্রাণকর্তা। এতদভিন্ন কে আপনার ত্রাণকর্তা? একমাত্র আপনাকে সুসংযত ও সুদান্ত অবস্থায় অধিষ্ঠিত রেখে আপনি নিজের আপনার ইহ-পরকালের জন্য দুর্লভ আশ্রয়স্থল বির্নিমাণ করতে পারেন।[expander_maker id=”1″ more=”Read More” less=”Read less”]
তাই করুণাঘন বুদ্ধের ধর্ম-দেশনানুসারে যাঁরা সংসার ত্যাগী ভিক্ষু তাঁরা আত্মশুদ্ধির জন্যে আত্মচর্চা করেন। আত্মঅন্বেষণ করেন। আত্মসমীক্ষা চালান। আত্মচর্চার মধ্য দিয়ে আত্মশক্তির চরম সীমায় অধিষ্ঠিত হন। আত্মশক্তির শীর্ষ চুড়ায় উপনীত হয়ে আত্যন্তিক চিত্ত সংযমতার মধ্য দিয়ে প্রতীত্যসমুৎপাদ তথা ভবচক্র, সংসারচক্র ও ভববন্ধন ছিন্নকরনসহ একত্রিশ লোকভূমির বাইরে গিয়ে পরিপূর্ণভাবে কর্মবীজ ক্ষয় করেন। রতন সূত্রানুসারে কর্মবীজ ক্ষয়ের সংজ্ঞাটি নিম্নরূপ-
‘খীণং পুরানং নবং নত্থি সম্ভবং
বিরত্তচিত্তা আযতিকে ভবস্মিং,
তে খীণাবীজা অবিরূল্ হিচ্ছন্দা
নিব্বন্তি ধীরা যথা’যং পদীপো।
ভিক্ষু সংঘের মধ্যে যাঁরা শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষপুঙ্গব, যাঁরা নির্বাণমৃত আস্বাদন করেছেন তাঁদের পুরাতন কর্মবীজ ক্ষয় হয়, নতুন কর্মবীজ উৎপন্ন হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না, ভবিষ্যৎ জন্ম গ্রহণের জন্য তাঁদের আর আসক্তি থাকে না বিধায় নির্বাপিত প্রদীপ তুল্য তাঁরা নির্বাণ প্রাপ্ত হন।
কিন্তু মর্মযাতনা হল এখানে একজন সংসার ত্যাগী বৌদ্ধ ভিক্ষু, তিনি এবং তাঁরা আবার যেন তেন বৌদ্ধ ভিক্ষু নন, এক এক জন স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী আর্যপুরুষপুঙ্গব ষড়াভিজ্ঞাধারী মহৎজন আত্মচর্চা, আত্মসমীক্ষা, আত্মঅন্বেষণ, আত্মউন্নয়ন, শীল, সমাধি প্রজ্ঞার সাধনায় তাঁদের মন চিত্তের উৎকর্ষ সাধনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারসমুহকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিযে আগাগোড়া পরচর্চার, পরনিন্দার, পরছিদ্রাণ্বেষণে জীবনপাত করেন। বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশের অসংখ্য অসংখ্য সহজ, সরল, পুণ্যপিপাসু দায়কদায়িকা যাঁরা উপরোক্ত মহৎজনদের কাছে নিছক দুঃখ মুক্তির আশায়, পুণ্যার্জনের জন্য, ইহ-পরলৌকিক মাঙ্গলিক কর্ম সম্পাদনার্থে তাঁরা তাদের কাছে উপস্থিত হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। এরূপ-জনজোয়ারের মোক্ষম সময়ে স্বঘোষিত ষড়ভিজ্ঞাধারী শ্রাবকবুদ্ধ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) মহোদয়কে ঘিরে ১৯৭৪ খিঃ অব্দ পর্যন্ত আয়োজিত অনুষ্ঠানসমূহে স্বয়ং শ্রাবকবুদ্ধ মহোদয় নিরন্তর পরচর্চার মহোৎসব চালিয়ে এসেছেন। লক্ষ লক্ষ পুণ্যপিপাসু দায়কদায়িকার জনসমুদ্রে স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ ও মার্গলাভী আর্যপুরুষপুঙ্গবরা কিরূপ ধর্ধভাষণে দ্বারা উপস্থিত জনমন্ডিলিকে তৃপ্ত করেন? দীর্ঘ ৩৯ (উনচল্লিশ) বছরের ব্যাপ্তিকালে ক্যাসেটে বাণীবদ্ধ ধর্মভাষণসমূহ পুনরায় কেউ যদি বাজিয়ে শোনেন তাহলে তাদের এই প্রতীতী জন্মাবে যে, তাঁদের বিরুদ্ধ পক্ষ ভিক্ষুদেরকে গালমন্দ, তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষায় কুৎসারটনা ও ছিদ্রান্বেষণ করাই বোধ হয় ঐ সব ধর্মভাষণসমূহের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল।
উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ্য-১৯৭৩ খ্রি: অব্দের কথা। তখন স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির মহোদয় লংগদুর তিনটিলা বনবিহারে অবস্থান করছিলেন। সে বছর বনবিহারে একটি বিরাট দানোত্তম কঠিনচীবরদানানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা তৈরি করে, সে সুতা দিয়ে কাপড় বুনন করে, ঐ বুনন কৃত কাপড় রঞ্জন করে, রঞ্জন করা কাপড় দিয়ে চীবর সেলাই করে তা শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তের উপস্থিতে (৫) পাঁচ শতাদিক মহাভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দান করা হয়। সেই মহাদানযজ্ঞে লক্ষ পুন্যার্থী সমাগম হয়েছিল বলে প্রত্যেক্ষদর্শীদের অভিমত। তখন বনভিক্ষুসংঘের আবির্ভাব হয়নি। পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশের তাবৎ ভিক্ষুসংঘ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গোটা জন মানসের হৃদস্পন্দন ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির(বনভান্তে)-কে ঘিরে বুদ্ধের শাসন-সদ্ধর্মের উত্তরোত্তর উন্নয়নের স্বপ্নজালবুনে চলছিল। শুধু পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ নয়, চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সমতল বড়ৃযা বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের সুপ্রাচীন সংগঠন সংঘরাজ নিকায় ও মহাস্থবির নিকায়ের তাবৎ মহাভিক্ষুসংঘ অভাগ বিস্ময়ে সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) মহোদয়ের কর্মকান্ড গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
কিন্তু দুঃখ ভারাক্রান্ত অন্তঃকরণে এই বিষয়টি তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি য়ে, ১৯৭৩খিঃ অব্দের মহাসাড়ম্বরপুর্ণ কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের পরদিন স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) মহোদয় সেই কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানে উপস্থিত সকল ভিক্ষুসংঘকে অসংখ্য সহজ সরল পুণ্যার্থী দায়কদায়িকাদের সম্মুখে প্রেত, শকুন ও বাজার পরিষ্কারক আখ্যায় আখ্যায়িত করার পরাকাষ্টা প্রদর্শন করলেন। পুণ্যার্থী দায়ক দায়িকাদের কাছে তিনি জানতে চাইলেন-প্রেতরা কি চলে গেছে? শকুনরা কি চলে গেছে? আর বাজার পরিষ্কারকরা কি চলে গেছে?
এ মর্ম যাতনাপুর্ণ উক্তি শুনে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশের তাবৎ ভিক্ষুসংঘ নিদারুণভাবে দুঃখভারাক্রান্ত অন্তঃকরণে মুষড়ে পড়েন। একজন শ্রাবকবুদ্ধের মুখ থেকে অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র মহাসমুদ্র সদৃশ মহাসংঘকে উদ্দেশ্য করে এ কি মর্মঘাতি উচ্চারণ? তিনি কি স্বজ্ঞানে এবম্বিধ বদ্ শব্দসমূহ মহাসংঘের প্রতি উদ্দেশ্য করে উচ্চারণ করেছেন? যদি তাই হয় তাহলে নিম্নরূপ সংঘ বন্দনার তাৎপর্য রইল কোথায়?
সঙ্ঘো বিসুদ্ধো বড় দক্ খিনেয্যো
সন্তিন্দ্রিয সব্ব মলপ্পহীনো।
গুণেহি নেকেহি সমিদ্ধিপত্তো,
অনাসবো তং পণমামি সঙ্ঘং।
অনুবাদঃ বিশুদ্ধদানের পাত্র সংঘ শ্রেষ্ঠ অতি,
নির্মল-ইন্দ্রিয়-শান্ত-ঋজুপথে গতি।
তৃষ্ণামুক্ত অনাসক্ত সংঘগুণ স্মরি,
এহেন সংঘের সদাই নমস্কার করি।
এরপর পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশের সদস্যভুক্ত কোন ভিক্ষুসংঘ ষড়াভিজ্ঞাধারী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তেকে ঘিরে আয়োজিত কোন দানানুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে দ্বিতীয়বার প্রেত, শকুন আর বাজার পরিষ্কারক হতে যাননি।
অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র বর্তমান মহাভিক্ষুসংঘের কাছে আমার প্র্শ্ন ভিক্ষুসংঘ যদি উপরোক্ত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধের কাছে প্রেত, শকুন আর বাজার পরিষ্কারক আখ্যায় আখ্যায়িত হন তাহলে বুদ্ধের শাসন সদ্ধর্মের অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র, দান দেবার উর্বর ক্ষেত্র বলে মহাসমুদ্র সদৃশ সংঘের সর্বজনীন চিরন্তন গুরুত্ব আর রইল কি? জনমানসে বুদ্ধরত্ন, ধর্মরত্ন আর সংঘরত্নের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো?
পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশ আর বনভিক্ষুসংঘের মধ্য(যদিও তখনও বন ভিক্ষুসংঘের আবির্ভাব ঘটেনি) বিভাজন সৃষ্টির বিষয় বৃক্ষ ঐ ১৯৭৩ খ্রিঃ অব্দের দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের মধ্যে ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির(বনভান্তে) মহোদয়ের দ্বারাই সজ্ঞানে বপিত হয়েছিল। ১৯৭৪ খ্রিঃ অব্দের দিকে ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ (স্বঘোষিত) বনভান্তে মহোদয় রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে স্থায়ীভাবে অবস্থানের লক্ষে চলে আসেন। বস্তুত ১৯৭৪ খ্রিঃ অব্দ থেকেই বলা যায় তার পরিনির্বাপিত হওয়ায় আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৯(উনচল্লিশ) বছর তিনি পার্বত্য ভিক্ষু বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ভিক্ষুসংঘকে ইতরজনোচিতভাবে গালমন্দ তথা নিন্দা্বাদ প্রচার করার পরাকাষ্টা দেখিয়ে এসেছেন। শুধু স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) নন তাঁর শিষ্য প্রশিষ্যরাও তাঁর জীবদ্দশায় হরহামেশা ‘বন সংঘ সুশীল, অপরদিকে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ দুঃশীল, বনসংঘকে দান করলে স্বর্গে যেতে পারবেন ,নির্বান লাভ করতে পারবেন, দুঃখমুক্ত হতে পারবেন। আর পার্বত্য ভিক্ষু সংঘকে দান করলে তারা যেহেতু দুঃশীল সেহেতু তাঁদেরকে দান করলে দান দাতার নরকের দ্বার উন্মুক্ত হবে’ বলে সব সময় নিন্দাবাদ করে এসেছেন। স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ মহোদয়ের নিরন্তর নিন্দাবাদের আওতা থেকে পরমারাধ্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরো মহোদয় ও বাদ যাননি। অনন্যোপায় হয়ে তিনি ১৯৭৬ খ্রিঃ অব্দে শেষ ভাগে বহু ঐতিহ্যমন্ডিত চাকমা রাজবিহার ত্যাগ করে তার জন্মস্থান বিলাইছড়ি চলে যেতে বাধ্য হন। অথচ মহামান্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির মহোদয় শ্রাবকবুদ্ধ মহোদয়ের আচরিয় আর উপধ্যায় গুরু হিসেবে ভিক্ষু সীমায় উপস্থিত থেকে তাঁকে Higher ordination প্রধান করার পরম পরাকাষ্টা প্রদর্শন করেছিলেন। কি অপ্রমেয় অসাধারণ গুরু দক্ষিণার বদৌলতে আমাদের আলোচ্য ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তে মহোদয় রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরো মহোদয়কে রাজবিহার ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন তা-মহাসংঘ দয়া করে একটু ভেবে দেখবেন কি?
পরমারাধ্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির মহোদয় ১৯৫৮ খ্রিঃ অব্দে চাকমা রাজগুরু হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন বর্তমান পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন এ সংঘের নাম ছিল ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিক্ষু সমিটি, পূর্ব পাকিস্তান। কর্মচক্রের কি নির্মম পরিহাস, আমাদের সকলের পরমারাধ্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরো মহোদয় অনেকটা অভিমানে, অনেকটা অপমানে, নিদারুণ গুরুত্বহীনতার বোঝা মাতায় নিয়ে ১৯৮০ খ্রিঃ অব্দের দিকে জন্মভুমি বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতের আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
বাস্তব অভিজ্ঞাতার আলোকে বলা যায় দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে আমাদের ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ ও তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বনসংঘ পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভুক্ত ভিক্ষুসংঘের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক নিন্দাবাদ প্রচার করে যে সব বৌদ্ধ বিহারসমূহে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভুক্ত ভিক্ষুসংঘ অবস্থান করেন সেসব বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে পরিচালনা কমিটিতে একশ্রেণীর দায়কদায়িকা থাকতে অনিহা প্রকাশ করতেন। কারণ, এসব বৌদ্ধ মন্দিরে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভুক্ত ভিক্ষুসংঘ অবস্থান করার কারণে দায়কদায়িকার আনাগোনা কম হওয়ায দরুণ কোন আয় উন্নতি হতোনা। জনজোয়ার যেসব মন্দির সমূহে বহমান ছিল সেসব মন্দিরে আয়-উন্নতি বেশী হতো। যে সব মন্দিরে জনসমাগম জনসমুদ্রে পরিণত হয় সে সব মন্দিরে আয় উন্নতি পরিমাণ তুলনামূলকভাবে আকাশচুম্বী ছিল। তাই সে সব মন্দিরে পরিচালনা কমিটি গঠনের বেলায় ঢাকাস্থ ভিকারুন্নেসানুন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির গঠনের সময় যেরূপ সদস্যবর্গ স্কুল কমিটির সদস্য হওয়ায় জন্য ক্যাম্পেইন করতেন , ঐ সব মন্দিরের সদস্য নির্বাচনের মুহূর্তেও তদনুরূপ ক্যাম্পেইনের প্রয়োজন হয় বলে শুনেছি। এটিও শুনেছি সেসব মন্দিরে ম্যানেজিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় জন্য সদস্য-সদস্যদের মধ্যে অতিরিক্ত আগ্রহ থাকার কারণে দস্তুর মতো ভোটাভোটির মাধ্যমে কমিটি গঠন করতে হতো। কোন কোন সময় ঐ সব মন্দিরে সাধারণ সদস্যদের মধ্যে পরিচালনা কমিটি গঠনের সময় হাটাহাটির মতো বিবদমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয বলে শোনা যায়। এটিও শোনা গেছে জনজোয়ারের অভিঘাতে জননন্দিত বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে বহু আগ থেকে একশ্রেণীর সুবিধাবাদী, চালবাজ, উচ্ছিষ্টভোগী শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে বলেও তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অভিমত। এ শ্রেণীর লোকদের ডিজিটাল চালবাজি ধরার বা চেনার মতো যোগ্যতা সহজ সরল পুণ্যর্থী জনগণের নেই। এ ডিজিটাল চালবাজ লোকেরা শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষপুঙ্গবদের ব্যাপারে সাধারণ পুণ্যার্থী জনগণের মাঝে অলৌকিকতামন্ডিত গরম গরম খবর ছড়িযে দিয়ে জনসমুদ্রে টোপ ফেলেন। বস্তুত শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, আর্যপুরুষ প্রভৃতি অভিধাসমূহও ঐসব চালবাজ শ্রেণীর লোকদের দ্বারাই প্রদত্ত বলে অনেকের অভিমত। সহজ সরল সাধারণ পুণ্যার্থী জনগণকে এর জন্য দায়ী বলা যায় না। তারা এসব গালভরা অভিধাসমূহের শ্রোতামাত্র।
সাধারণ সহজ সরল পুণ্যার্থী জনগণ শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষের সংজ্ঞা জানেন না। মোর্দাকথায় তাঁরা পুণ্যার্থী পুণ্য সম্পাদনের লক্ষে জনজোয়ারে তারা সামিল হন। পুণ্য মাপজোক করার যেহেতু কোন মাপকাঠি নেই সেহেতু সম্বৎসরের দুঃখকষ্ট থেকে একটু লাঘব পাবার আশায় তথাকথিত শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষদের পাদমূলে বসে দান করতে পারলে তারা আকাশের চাঁদ হাতে পান। দানের মধ্যে যে অপার আনন্দ ও প্রশান্তি তাই নিয়ে তাঁরা ঘরে ফেরেন। তাঁদের এ কষ্টের দান-কে কিভারে খরচ করলো-তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই।
ইতিহাস বলে ধর্ম সৃষ্ঠির পর থেকে মানুষ নানাভাবে ধর্মের কারণে একশ্রেণীর বেনিয়া মনোবৃত্তি সম্পন্ন ধর্ম গুরুদের দ্বারা শোষণ-যন্ত্রণার শিকার হয়ে আসছেন। সম্ভ্রাট, রাজা, সামন্ত অধিপতিদের শোষণ- যন্ত্রণার কথা আমরা লোকমুখে শুণে এসেছি ও ইতিহাসে পড়ে এসেছি। তাঁরা প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ করের আওতায় এনে সাধারণ জনগণ তথা প্রজা সাধারণকে শোষণ করতেন। দরিদ্র প্রজা ট্যাক্স দিতে না পারলে তাদেঁর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হতেন। দরিদ্র প্রজাদের বিত্তবেসাত তাঁরা ক্রোক করে হলেও তাঁদের ধন ভান্ডারে জমা করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখার বলেছেন-শুধু, রাজা, সামন্তঅধিপতিরা নন ধর্ম ব্যবসায়ীরাও গরীব দুঃখী প্রজা সাধারণকে নির্মমভাবে বহুকাল আগ থেকে শোষণ করে যাচ্ছেন। ধর্ম ব্যবসায়ীরা গরীব জনগণকে কিভাবে শোষণ করেন, তাঁর জবানীতে তা নিম্নরূপঃ
‘একজন সম্রাট, রাজা অথবা সামন্তঅধিপতি তাঁর প্রজাদের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর চাপিয়ে দিয়ে যতটুকু শোষণ করতে পারে একজন তার ধর্মীয় বুজুর্ গী দিয়ে শতগুণ বেশী শোষণ করতে পারেন। ধর্মযাজকদের শোষণটা হয় খুব আরামের শোষণ। কারণ তাঁর শোষণের হাতিয়ার হিসেবে পুলিশ, দারোগা, পাইক পেয়াদা, বরকন্দাজ কোন কিছুই লাগে না।’ ধর্মীয় বজুরগী বা চালবাজী সেই চালবাজীর অভিনব প্রচারের বদৌলতে সাধারণ জনগণ ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে জাগতিক নিয়মে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বর্গ, মোক্ষ, নির্বাণের লোভে, মৃত্যুর পর সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় অথবা জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্তির এষণায় অতি সহজে ধরা দিতে বাধ্য হন। আমাদের শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষরাও ধর্মব্যবসায়ী কিনা জানি না। তাঁদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিহ্নিত করার সময় এখননো আসেনি তবে সময় ঘনিয়ে আসছে। কালের ইতিহাসই এই পরিচিহ্নিত করণের কাজটি ঠিকই করে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমাদের শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষদের কাছে এবং তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্য মণ্ডলীর জবাণীতে স্বর্গ-মোক্ষ-নির্বাণলাভ তথা সর্ব দুঃখের অন্তসাধণ পূর্বক পরিপূর্ণভাবে ইহ জীবনে কর্ম বীজ ক্ষয় করা অনেকটা পান্তা ভাতের মতো সহজলভ্য। তাঁরা প্রতিনিয়ত স্রোতপত্তি, সকৃদাগামী, অনাগামী ও অর্হত্ব মার্গ ও ফল সবসময় লাভ করে চলেছের। পৃথিবী নাকি অর্হত শূণ্য থাকে না। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে কতজন অর্হত রয়েছেন তাঁর হদিশ পাওয়া কঠিন। (চলবে……..)
লেখকঃ সভাপতি, পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশ, বহু জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।
ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো
বাংলা একাডেমী কর্তৃক মুদ্রিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে পরচর্চার অর্থ করা হয়েছে অন্যের সম্বন্ধে আলোচনা, পরনিন্দা, অপরের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা। একজন সত্যিকার মনুষ্যত্ববোধে ঋদ্ধ সংসার সমুদ্র পাড়ি দেওয়ায় লক্ষ্যে সংসার ত্যাগী বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেলায় সর্বতোভাবে বর্জনীয়। একজন সাধারণ মানুষও পারতপক্ষে পরচর্চার বশবর্তী হন না। একজন সাধারণ পৃথকজন পুদগল বা ব্যক্তি আর, একজন সংসার ত্যাগী মুক্তি প্রত্যাশী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে পরচর্চা সংক্রান্ত বিষয়টি তাদের স্ব স্ব মনে দ্বি-ভাবে অনুরক্তি সৃষ্টি করতে পারে। বর্তমান সময়ে হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে, প্রতিপক্ষকে জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে খুবই বাজে মানসিকতা সম্পন্ন একজন সাধারণ পৃথকজন ব্যক্তি বা পুদ্ গল পরচর্চা বা পরনিন্দার বশবর্তী হতে পারেন। ইদানিং রাজনীতিতেও একহাত দেখে নেয়ার অভিপ্রায়ে অথবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য পরচর্চার একটি বাজে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে-যা সুধী সমাজে তা খুবই নিন্দনীয়, হীন, জঘন্য, ইতরজনোচিত, অভদ্রজনোচিত বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।
মানুষ কথনো সর্বক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পন্ন নন। লোক সমাজে প্রচলিত প্রবাদ-’দোষে গুণে মানুষ’। লোকয়ত লৌকিক জীবনে কি ভিক্ষু কি সাধারণ গৃহী জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে নানা ধরণের কাজ, নানা শিল্প বিদ্যায় নিজেদেরকে ব্রতী করতে পারেন। তবে সংসার ত্যাগী ভিক্ষুদের বেলায় যেহেতু তাঁরা রং বস্ত্র ধারণ করে আগার থেকে অনাগারিক জীবন গ্রহণ করেন সেহেতু পরচর্চার পরিবর্তে আত্মচর্চা, আত্মঅন্বেষণ, আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে সর্বপ্রযত্ন আত্মনিবেদন থাকা জরুরী বলে করুণাঘন বুদ্ধের কঠোর দিক নির্দেশনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে করুণাঘন বুদ্ধের কম্বুকণ্ঠের উচ্চারণ হল-
‘অত্তদীপা বিহারথ অত্তসরণা অনঞ্ঞসরণা,
হে আনন্দ, তোমরা আত্মদীপ হয়ে বিহার কর। আত্মশরণ ও অনন্য শরণ হও।
তস্মা তিহানন্দ-‘দম্মদীপা ধম্মসরণা অনঞ্ঞসরণা’
আত্মশরণ ও অনন্য হয়ে ধম্মদীপ ধম্মশরণকে অনন্যশরণ রূপে জাগ্রত রেখে বিহার কর। বুদ্ধ আরো বলেছেন-
‘অত্তহি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরো সিযা?
অত্তনাব সুদন্তেন নাথং লভতি দুল্লভং।’
আপনা গোটা জীবনের আপনি আপনার ত্রাণকর্তা। এতদভিন্ন কে আপনার ত্রাণকর্তা? একমাত্র আপনাকে সুসংযত ও সুদান্ত অবস্থায় অধিষ্ঠিত রেখে আপনি নিজের আপনার ইহ-পরকালের জন্য দুর্লভ আশ্রয়স্থল বির্নিমাণ করতে পারেন।
তাই করুণাঘন বুদ্ধের ধর্ম-দেশনানুসারে যাঁরা সংসার ত্যাগী ভিক্ষু তাঁরা আত্মশুদ্ধির জন্যে আত্মচর্চা করেন। আত্মঅন্বেষণ করেন। আত্মসমীক্ষা চালান। আত্মচর্চার মধ্য দিয়ে আত্মশক্তির চরম সীমায় অধিষ্ঠিত হন। আত্মশক্তির শীর্ষ চুড়ায় উপনীত হয়ে আত্যন্তিক চিত্ত সংযমতার মধ্য দিয়ে প্রতীত্যসমুৎপাদ তথা ভবচক্র, সংসারচক্র ও ভববন্ধন ছিন্নকরনসহ একত্রিশ লোকভূমির বাইরে গিয়ে পরিপূর্ণভাবে কর্মবীজ ক্ষয় করেন। রতন সূত্রানুসারে কর্মবীজ ক্ষয়ের সংজ্ঞাটি নিম্নরূপ-
‘খীণং পুরানং নবং নত্থি সম্ভবং
বিরত্তচিত্তা আযতিকে ভবস্মিং,
তে খীণাবীজা অবিরূল্ হিচ্ছন্দা
নিব্বন্তি ধীরা যথা’যং পদীপো।
ভিক্ষু সংঘের মধ্যে যাঁরা শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষপুঙ্গব, যাঁরা নির্বাণমৃত আস্বাদন করেছেন তাঁদের পুরাতন কর্মবীজ ক্ষয় হয়, নতুন কর্মবীজ উৎপন্ন হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না, ভবিষ্যৎ জন্ম গ্রহণের জন্য তাঁদের আর আসক্তি থাকে না বিধায় নির্বাপিত প্রদীপ তুল্য তাঁরা নির্বাণ প্রাপ্ত হন।
কিন্তু মর্মযাতনা হল এখানে একজন সংসার ত্যাগী বৌদ্ধ ভিক্ষু, তিনি এবং তাঁরা আবার যেন তেন বৌদ্ধ ভিক্ষু নন, এক এক জন স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী আর্যপুরুষপুঙ্গব ষড়াভিজ্ঞাধারী মহৎজন আত্মচর্চা, আত্মসমীক্ষা, আত্মঅন্বেষণ, আত্মউন্নয়ন, শীল, সমাধি প্রজ্ঞার সাধনায় তাঁদের মন চিত্তের উৎকর্ষ সাধনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারসমুহকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিযে আগাগোড়া পরচর্চার, পরনিন্দার, পরছিদ্রাণ্বেষণে জীবনপাত করেন। বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশের অসংখ্য অসংখ্য সহজ, সরল, পুণ্যপিপাসু দায়কদায়িকা যাঁরা উপরোক্ত মহৎজনদের কাছে নিছক দুঃখ মুক্তির আশায়, পুণ্যার্জনের জন্য, ইহ-পরলৌকিক মাঙ্গলিক কর্ম সম্পাদনার্থে তাঁরা তাদের কাছে উপস্থিত হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। এরূপ-জনজোয়ারের মোক্ষম সময়ে স্বঘোষিত ষড়ভিজ্ঞাধারী শ্রাবকবুদ্ধ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) মহোদয়কে ঘিরে ১৯৭৪ খিঃ অব্দ পর্যন্ত আয়োজিত অনুষ্ঠানসমূহে স্বয়ং শ্রাবকবুদ্ধ মহোদয় নিরন্তর পরচর্চার মহোৎসব চালিয়ে এসেছেন। লক্ষ লক্ষ পুণ্যপিপাসু দায়কদায়িকার জনসমুদ্রে স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ ও মার্গলাভী আর্যপুরুষপুঙ্গবরা কিরূপ ধর্ধভাষণে দ্বারা উপস্থিত জনমন্ডিলিকে তৃপ্ত করেন? দীর্ঘ ৩৯ (উনচল্লিশ) বছরের ব্যাপ্তিকালে ক্যাসেটে বাণীবদ্ধ ধর্মভাষণসমূহ পুনরায় কেউ যদি বাজিয়ে শোনেন তাহলে তাদের এই প্রতীতী জন্মাবে যে, তাঁদের বিরুদ্ধ পক্ষ ভিক্ষুদেরকে গালমন্দ, তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষায় কুৎসারটনা ও ছিদ্রান্বেষণ করাই বোধ হয় ঐ সব ধর্মভাষণসমূহের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল।
উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ্য-১৯৭৩ খ্রি: অব্দের কথা। তখন স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির মহোদয় লংগদুর তিনটিলা বনবিহারে অবস্থান করছিলেন। সে বছর বনবিহারে একটি বিরাট দানোত্তম কঠিনচীবরদানানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা তৈরি করে, সে সুতা দিয়ে কাপড় বুনন করে, ঐ বুনন কৃত কাপড় রঞ্জন করে, রঞ্জন করা কাপড় দিয়ে চীবর সেলাই করে তা শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তের উপস্থিতে (৫) পাঁচ শতাদিক মহাভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দান করা হয়। সেই মহাদানযজ্ঞে লক্ষ পুন্যার্থী সমাগম হয়েছিল বলে প্রত্যেক্ষদর্শীদের অভিমত। তখন বনভিক্ষুসংঘের আবির্ভাব হয়নি। পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশের তাবৎ ভিক্ষুসংঘ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গোটা জন মানসের হৃদস্পন্দন ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির(বনভান্তে)-কে ঘিরে বুদ্ধের শাসন-সদ্ধর্মের উত্তরোত্তর উন্নয়নের স্বপ্নজালবুনে চলছিল। শুধু পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ নয়, চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সমতল বড়ৃযা বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের সুপ্রাচীন সংগঠন সংঘরাজ নিকায় ও মহাস্থবির নিকায়ের তাবৎ মহাভিক্ষুসংঘ অভাগ বিস্ময়ে সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) মহোদয়ের কর্মকান্ড গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
কিন্তু দুঃখ ভারাক্রান্ত অন্তঃকরণে এই বিষয়টি তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি য়ে, ১৯৭৩খিঃ অব্দের মহাসাড়ম্বরপুর্ণ কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের পরদিন স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) মহোদয় সেই কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানে উপস্থিত সকল ভিক্ষুসংঘকে অসংখ্য সহজ সরল পুণ্যার্থী দায়কদায়িকাদের সম্মুখে প্রেত, শকুন ও বাজার পরিষ্কারক আখ্যায় আখ্যায়িত করার পরাকাষ্টা প্রদর্শন করলেন। পুণ্যার্থী দায়ক দায়িকাদের কাছে তিনি জানতে চাইলেন-প্রেতরা কি চলে গেছে? শকুনরা কি চলে গেছে? আর বাজার পরিষ্কারকরা কি চলে গেছে?
এ মর্ম যাতনাপুর্ণ উক্তি শুনে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশের তাবৎ ভিক্ষুসংঘ নিদারুণভাবে দুঃখভারাক্রান্ত অন্তঃকরণে মুষড়ে পড়েন। একজন শ্রাবকবুদ্ধের মুখ থেকে অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র মহাসমুদ্র সদৃশ মহাসংঘকে উদ্দেশ্য করে এ কি মর্মঘাতি উচ্চারণ? তিনি কি স্বজ্ঞানে এবম্বিধ বদ্ শব্দসমূহ মহাসংঘের প্রতি উদ্দেশ্য করে উচ্চারণ করেছেন? যদি তাই হয় তাহলে নিম্নরূপ সংঘ বন্দনার তাৎপর্য রইল কোথায়?
সঙ্ঘো বিসুদ্ধো বড় দক্ খিনেয্যো
সন্তিন্দ্রিয সব্ব মলপ্পহীনো।
গুণেহি নেকেহি সমিদ্ধিপত্তো,
অনাসবো তং পণমামি সঙ্ঘং।
অনুবাদঃ বিশুদ্ধদানের পাত্র সংঘ শ্রেষ্ঠ অতি,
নির্মল-ইন্দ্রিয়-শান্ত-ঋজুপথে গতি।
তৃষ্ণামুক্ত অনাসক্ত সংঘগুণ স্মরি,
এহেন সংঘের সদাই নমস্কার করি।
এরপর পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশের সদস্যভুক্ত কোন ভিক্ষুসংঘ ষড়াভিজ্ঞাধারী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তেকে ঘিরে আয়োজিত কোন দানানুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে দ্বিতীয়বার প্রেত, শকুন আর বাজার পরিষ্কারক হতে যাননি।
অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র বর্তমান মহাভিক্ষুসংঘের কাছে আমার প্র্শ্ন ভিক্ষুসংঘ যদি উপরোক্ত ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধের কাছে প্রেত, শকুন আর বাজার পরিষ্কারক আখ্যায় আখ্যায়িত হন তাহলে বুদ্ধের শাসন সদ্ধর্মের অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র, দান দেবার উর্বর ক্ষেত্র বলে মহাসমুদ্র সদৃশ সংঘের সর্বজনীন চিরন্তন গুরুত্ব আর রইল কি? জনমানসে বুদ্ধরত্ন, ধর্মরত্ন আর সংঘরত্নের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো?
পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশ আর বনভিক্ষুসংঘের মধ্য(যদিও তখনও বন ভিক্ষুসংঘের আবির্ভাব ঘটেনি) বিভাজন সৃষ্টির বিষয় বৃক্ষ ঐ ১৯৭৩ খ্রিঃ অব্দের দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের মধ্যে ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির(বনভান্তে) মহোদয়ের দ্বারাই সজ্ঞানে বপিত হয়েছিল। ১৯৭৪ খ্রিঃ অব্দের দিকে ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ (স্বঘোষিত) বনভান্তে মহোদয় রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে স্থায়ীভাবে অবস্থানের লক্ষে চলে আসেন। বস্তুত ১৯৭৪ খ্রিঃ অব্দ থেকেই বলা যায় তার পরিনির্বাপিত হওয়ায় আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৯(উনচল্লিশ) বছর তিনি পার্বত্য ভিক্ষু বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ভিক্ষুসংঘকে ইতরজনোচিতভাবে গালমন্দ তথা নিন্দা্বাদ প্রচার করার পরাকাষ্টা দেখিয়ে এসেছেন। শুধু স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ ভদন্ত সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) নন তাঁর শিষ্য প্রশিষ্যরাও তাঁর জীবদ্দশায় হরহামেশা ‘বন সংঘ সুশীল, অপরদিকে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ দুঃশীল, বনসংঘকে দান করলে স্বর্গে যেতে পারবেন ,নির্বান লাভ করতে পারবেন, দুঃখমুক্ত হতে পারবেন। আর পার্বত্য ভিক্ষু সংঘকে দান করলে তারা যেহেতু দুঃশীল সেহেতু তাঁদেরকে দান করলে দান দাতার নরকের দ্বার উন্মুক্ত হবে’ বলে সব সময় নিন্দাবাদ করে এসেছেন। স্বঘোষিত শ্রাবকবুদ্ধ মহোদয়ের নিরন্তর নিন্দাবাদের আওতা থেকে পরমারাধ্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরো মহোদয় ও বাদ যাননি। অনন্যোপায় হয়ে তিনি ১৯৭৬ খ্রিঃ অব্দে শেষ ভাগে বহু ঐতিহ্যমন্ডিত চাকমা রাজবিহার ত্যাগ করে তার জন্মস্থান বিলাইছড়ি চলে যেতে বাধ্য হন। অথচ মহামান্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির মহোদয় শ্রাবকবুদ্ধ মহোদয়ের আচরিয় আর উপধ্যায় গুরু হিসেবে ভিক্ষু সীমায় উপস্থিত থেকে তাঁকে Higher ordination প্রধান করার পরম পরাকাষ্টা প্রদর্শন করেছিলেন। কি অপ্রমেয় অসাধারণ গুরু দক্ষিণার বদৌলতে আমাদের আলোচ্য ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তে মহোদয় রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরো মহোদয়কে রাজবিহার ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন তা-মহাসংঘ দয়া করে একটু ভেবে দেখবেন কি?
পরমারাধ্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির মহোদয় ১৯৫৮ খ্রিঃ অব্দে চাকমা রাজগুরু হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন বর্তমান পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন এ সংঘের নাম ছিল ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিক্ষু সমিটি, পূর্ব পাকিস্তান। কর্মচক্রের কি নির্মম পরিহাস, আমাদের সকলের পরমারাধ্য রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরো মহোদয় অনেকটা অভিমানে, অনেকটা অপমানে, নিদারুণ গুরুত্বহীনতার বোঝা মাতায় নিয়ে ১৯৮০ খ্রিঃ অব্দের দিকে জন্মভুমি বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতের আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
বাস্তব অভিজ্ঞাতার আলোকে বলা যায় দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে আমাদের ষড়াভিজ্ঞালাভী শ্রাবকবুদ্ধ ও তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বনসংঘ পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভুক্ত ভিক্ষুসংঘের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক নিন্দাবাদ প্রচার করে যে সব বৌদ্ধ বিহারসমূহে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভুক্ত ভিক্ষুসংঘ অবস্থান করেন সেসব বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে পরিচালনা কমিটিতে একশ্রেণীর দায়কদায়িকা থাকতে অনিহা প্রকাশ করতেন। কারণ, এসব বৌদ্ধ মন্দিরে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভুক্ত ভিক্ষুসংঘ অবস্থান করার কারণে দায়কদায়িকার আনাগোনা কম হওয়ায দরুণ কোন আয় উন্নতি হতোনা। জনজোয়ার যেসব মন্দির সমূহে বহমান ছিল সেসব মন্দিরে আয়-উন্নতি বেশী হতো। যে সব মন্দিরে জনসমাগম জনসমুদ্রে পরিণত হয় সে সব মন্দিরে আয় উন্নতি পরিমাণ তুলনামূলকভাবে আকাশচুম্বী ছিল। তাই সে সব মন্দিরে পরিচালনা কমিটি গঠনের বেলায় ঢাকাস্থ ভিকারুন্নেসানুন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির গঠনের সময় যেরূপ সদস্যবর্গ স্কুল কমিটির সদস্য হওয়ায় জন্য ক্যাম্পেইন করতেন , ঐ সব মন্দিরের সদস্য নির্বাচনের মুহূর্তেও তদনুরূপ ক্যাম্পেইনের প্রয়োজন হয় বলে শুনেছি। এটিও শুনেছি সেসব মন্দিরে ম্যানেজিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় জন্য সদস্য-সদস্যদের মধ্যে অতিরিক্ত আগ্রহ থাকার কারণে দস্তুর মতো ভোটাভোটির মাধ্যমে কমিটি গঠন করতে হতো। কোন কোন সময় ঐ সব মন্দিরে সাধারণ সদস্যদের মধ্যে পরিচালনা কমিটি গঠনের সময় হাটাহাটির মতো বিবদমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয বলে শোনা যায়। এটিও শোনা গেছে জনজোয়ারের অভিঘাতে জননন্দিত বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে বহু আগ থেকে একশ্রেণীর সুবিধাবাদী, চালবাজ, উচ্ছিষ্টভোগী শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে বলেও তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অভিমত। এ শ্রেণীর লোকদের ডিজিটাল চালবাজি ধরার বা চেনার মতো যোগ্যতা সহজ সরল পুণ্যর্থী জনগণের নেই। এ ডিজিটাল চালবাজ লোকেরা শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষপুঙ্গবদের ব্যাপারে সাধারণ পুণ্যার্থী জনগণের মাঝে অলৌকিকতামন্ডিত গরম গরম খবর ছড়িযে দিয়ে জনসমুদ্রে টোপ ফেলেন। বস্তুত শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, আর্যপুরুষ প্রভৃতি অভিধাসমূহও ঐসব চালবাজ শ্রেণীর লোকদের দ্বারাই প্রদত্ত বলে অনেকের অভিমত। সহজ সরল সাধারণ পুণ্যার্থী জনগণকে এর জন্য দায়ী বলা যায় না। তারা এসব গালভরা অভিধাসমূহের শ্রোতামাত্র।
সাধারণ সহজ সরল পুণ্যার্থী জনগণ শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষের সংজ্ঞা জানেন না। মোর্দাকথায় তাঁরা পুণ্যার্থী পুণ্য সম্পাদনের লক্ষে জনজোয়ারে তারা সামিল হন। পুণ্য মাপজোক করার যেহেতু কোন মাপকাঠি নেই সেহেতু সম্বৎসরের দুঃখকষ্ট থেকে একটু লাঘব পাবার আশায় তথাকথিত শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষদের পাদমূলে বসে দান করতে পারলে তারা আকাশের চাঁদ হাতে পান। দানের মধ্যে যে অপার আনন্দ ও প্রশান্তি তাই নিয়ে তাঁরা ঘরে ফেরেন। তাঁদের এ কষ্টের দান-কে কিভারে খরচ করলো-তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই।
ইতিহাস বলে ধর্ম সৃষ্ঠির পর থেকে মানুষ নানাভাবে ধর্মের কারণে একশ্রেণীর বেনিয়া মনোবৃত্তি সম্পন্ন ধর্ম গুরুদের দ্বারা শোষণ-যন্ত্রণার শিকার হয়ে আসছেন। সম্ভ্রাট, রাজা, সামন্ত অধিপতিদের শোষণ- যন্ত্রণার কথা আমরা লোকমুখে শুণে এসেছি ও ইতিহাসে পড়ে এসেছি। তাঁরা প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ করের আওতায় এনে সাধারণ জনগণ তথা প্রজা সাধারণকে শোষণ করতেন। দরিদ্র প্রজা ট্যাক্স দিতে না পারলে তাদেঁর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হতেন। দরিদ্র প্রজাদের বিত্তবেসাত তাঁরা ক্রোক করে হলেও তাঁদের ধন ভান্ডারে জমা করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখার বলেছেন-শুধু, রাজা, সামন্তঅধিপতিরা নন ধর্ম ব্যবসায়ীরাও গরীব দুঃখী প্রজা সাধারণকে নির্মমভাবে বহুকাল আগ থেকে শোষণ করে যাচ্ছেন। ধর্ম ব্যবসায়ীরা গরীব জনগণকে কিভাবে শোষণ করেন, তাঁর জবানীতে তা নিম্নরূপঃ
‘একজন সম্রাট, রাজা অথবা সামন্তঅধিপতি তাঁর প্রজাদের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর চাপিয়ে দিয়ে যতটুকু শোষণ করতে পারে একজন তার ধর্মীয় বুজুর্ গী দিয়ে শতগুণ বেশী শোষণ করতে পারেন। ধর্মযাজকদের শোষণটা হয় খুব আরামের শোষণ। কারণ তাঁর শোষণের হাতিয়ার হিসেবে পুলিশ, দারোগা, পাইক পেয়াদা, বরকন্দাজ কোন কিছুই লাগে না।’ ধর্মীয় বজুরগী বা চালবাজী সেই চালবাজীর অভিনব প্রচারের বদৌলতে সাধারণ জনগণ ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে জাগতিক নিয়মে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বর্গ, মোক্ষ, নির্বাণের লোভে, মৃত্যুর পর সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় অথবা জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্তির এষণায় অতি সহজে ধরা দিতে বাধ্য হন। আমাদের শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষরাও ধর্মব্যবসায়ী কিনা জানি না। তাঁদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিহ্নিত করার সময় এখননো আসেনি তবে সময় ঘনিয়ে আসছে। কালের ইতিহাসই এই পরিচিহ্নিত করণের কাজটি ঠিকই করে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমাদের শ্রাবকবুদ্ধ, অনুবুদ্ধ, মার্গলাভী, আর্যপুরুষদের কাছে এবং তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্য মণ্ডলীর জবাণীতে স্বর্গ-মোক্ষ-নির্বাণলাভ তথা সর্ব দুঃখের অন্তসাধণ পূর্বক পরিপূর্ণভাবে ইহ জীবনে কর্ম বীজ ক্ষয় করা অনেকটা পান্তা ভাতের মতো সহজলভ্য। তাঁরা প্রতিনিয়ত স্রোতপত্তি, সকৃদাগামী, অনাগামী ও অর্হত্ব মার্গ ও ফল সবসময় লাভ করে চলেছের। পৃথিবী নাকি অর্হত শূণ্য থাকে না। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে কতজন অর্হত রয়েছেন তাঁর হদিশ পাওয়া কঠিন। (চলবে……..)
লেখকঃ সভাপতি, পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশ, বহু জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।[/expander_maker]