ব্যূহচক্র মেলা ও রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহার

ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো

রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারকে ঘিরে শুভ মাঘী পূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে ‘ব্যুহচক্র মেলা’ চিরাচরিত নিয়মে মহাসাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ১৯৩৪ ইংরেজী থেকে। ১৯৩৩ সালের দিকে তখনকার কিছু সদ্ধর্ম সচেতন দূরদর্শী দায়ক-দায়িকা এ আনন্দ বিহার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এঁদের মধ্যে রাজেন্দ্র নাথ তালুকদার, সুধন্য জীবন চাকমা, বীরেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দী, সুখেন্দু মুৎসুদ্দী, বাবু বলভদ্র তালুকদার, দিগম্বর বাবু, বাবু নিশিকান্ত তালুকদার, বান্দারাম বাবু, হলধর বাবু, মংক্যউ বাবু, কালী বড়ুয়া প্রমুখ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে ডাঃ যামিনী রঞ্জন চাকমার লেখা আনন্দ বিহারের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্তের মধ্যে পাওয়া যায়। আনন্দ বিহারের সম্ভাব্য অবস্থানটি বাছাই করার দায়িত্ব নেন ডাঃ যামিনী রঞ্জন চাকমা, বাবু নিশিকান্ত তালুকদার তাঁদের সঙ্গে এ কাজে সম্পৃক্ত করে নেন তখনকার পার্বত্য চট্রগ্রাম জিলায় কর্মরত চেইন ম্যান বাবু কালী বড়–য়াকে। তাঁরা সবদিক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ পূর্বক আনন্দ বিহারের বর্তমান অবস্থানটি বাছাই করেন। স্থান নির্বাচনের পর শুরু হয় বিহার নির্মাণের কাজ। সর্বসম্মতিক্রমে নামকরণ করা হয়- ‘আনন্দ বিহার’। হয়তো করুণাঘন বুদ্ধের অতীব স্নেহসিক্ত প্রধান উপস্থাপক (Attendant) অপার
ধীশক্তি সম্পন্ন আনন্দ স্থবিরকে সবিশেষ গুরুত্বারোপ পূর্বক এ বিহারের নাম ‘আনন্দ বিহার’ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যথানিয়মে ১.২০ একর পাহাড় আনন্দ বিহারের নামে নিষ্করভাবে বন্দোবস্ত লাভের জন্য তদানীন্তন সরকারের পার্বত্য চট্রগ্রাম জেলার মাননীয় জেলাপ্রশাসকের বরাবরে দরখাস্ত সহযোগে উপস্থিত হন বাবু সুধন্য জীবন চাকমা। তদানীন্তন মাননীয় জেলা প্রশাসক মহোদয় আনন্দ বিহারের নামে ১.২০ একর পাহাড় নিষ্করভাবে বন্দোবস্ত প্রদান করে পার্বত্য বৌদ্ধদের অশেষ কল্যাণ সাধন করেন এবং বৌদ্ধদেরকে চির কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেন।

রাজেন্দ্র নাথ তালুকদারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অস্থায়ীভাবে বাঁশের বেড়া ও ঢেউটিনের ছাউনি দিয়ে ’আনন্দ বিহার’ নির্মিত হল৤ শুরু হল এ নব প্রতিষ্ঠিত ও নব নির্মিত বিহারে একজন অধ্যক্ষ ভিক্ষু নিমন্ত্রণের পালা৤ তখনকার ডিস্ট্রিক ইন্‌পেক্টর অব স্কুল, বাবু বীরেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দী মহোদয়কে দেওয়া হয় একজন পন্ডিত ভিক্ষুকে এ নব প্রতিষ্ঠিত বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার দায়িত্ব৤

তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৪ সালে খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারীতে পণ্ডিত বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির মহোদয় এ মন্দিরের অধ্যক্ষ হিসেবে অধিষ্ঠিত হন৤ তিনি কত বছর অধ্যক্ষ হিসেবে মন্দিরে অবস্থান করেছিলেন তা ডাঃ যামিনী রঞ্জন চাক্‌মার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্তে নেই৤ ‘সত্যদর্শন’ নামক বইয়ের লেখক পরমপূজ্য ভদন্ত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো মহোদয় ছিলেন শ্রীলংকার ত্রিপিটক বিশারদ৤ তিনি বুদ্ধ ভাষা পালিতে ও বাংলা ভাষায় স্বচ্ছন্দে ও সাবলীলভাবে ভাষণ দিতে পারতেন বলে কথিত আছে৤ বস্তুতঃ রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহার প্রতিষ্ঠা লগ্ন তথা ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে থেকে বর্তমান বছর পর্যন্ত মহাসাড়ম্বরে আত্যন্তিক শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে ও বিশ্বাসে কর্ম ও কর্মফলের উপর বিশ্বাস রেখে শুভ মাঘী পূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারের পুত পবিত্র প্রাঙ্গনে ‘চক্রব্যূহ মেলা বা ব্যূহচক্র মেলা’ উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে চিরাচরিত নিয়মে৤ শুধু আনন্দ বিহারের শ্রদ্ধাবান দায়ক-দায়িকা নন, রাঙ্গামাটির আপামর বৌদ্ধ দায়ক-দায়িকাগণ সতৃঞ্চ নয়নে এ শুভ মাঘী পূর্ণিমার পরম পবিত্র দিনটির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণেন৤ ‘কবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে- সেই বহু প্রতীক্ষিত ব্যূহচক্র মেলা?’

চক্রব্যূহমানে কি?

বৌদ্ধরা
কর্মবাদী৤ আমরা বৌদ্ধরা বিশ্বাস
করি কর্ম ও কর্মফলকে৤
কর্মবহতা নদীর মতো৤ অনাদি
অনন্তকাল থেকে প্রতিটি জীবনের
কর্মপ্রবাহ বয়ে চলেছে বহতা
নদীর মতো৤ বৌদ্ধদের দৃঢ়
বিশ্বাস অতীতের কর্ম বিপাকের চূড়ান্ত
পরিণতি হল বর্তমান জন্ম৤
আর বর্তমান এ জীবন লাভ
করে তাবৎ জীবনে সদ-অসদ যা কিছু
কর্ম সম্পাদন করে যাবো- তাতেই
আমার ভবিষ্যৎ পরিণতি নির্ধারিত হবে৤ এ বিষয়ে
করুণাঘন বুদ্ধের কম্বুকন্ঠের উচ্চারণঃ

“অতীতের
হেতবো পঞ্চ, ইদানি ফল পঞ্চকং

ইদানি
হেতবো পঞ্চ, আয়তি ফল পঞ্চকন্তি৤”

অবিদ্যা, সংস্কার, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব- অতীতের পঞ্চ হেতু৤

বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা- বর্তমানের পঞ্চফল৤

অবিদ্যা, সংস্কার, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব- বর্তমানের হেতু৤

বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা- ভবিষ্যতের পঞ্চফল৤

এখানে প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি বা কার্য-কারণ নীতি বা  Law of
Dependent Origination কর্মভব ও উৎপত্তিভবের সমন্বিত বিন্যাসের মধ্যদিয়ে ব্যূহচক্র, ভবচক্র, সংসার চক্র, কর্মচক্ররূপে দেখানো হয়েছে৤ এ দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র, সংসারচক্র, কর্মচক্রের মধ্যদিয়ে একত্রিশ লোকভূমিতে আমরা তাবৎ জীব জগত ব্যূহচক্রের মধ্যে পরিভ্রমণরত অবস্থায় রয়েছি- অনাদি অনন্তকাল থেকে৤  কর্মবীজ
ক্ষয়প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে এই ব্যূহচক্রের মধ্যে উৎপত্তি, স্থিতি ও ভঙ্গের মধ্যে দিয়ে পরিভ্রমনরত অবস্থায় থাকতেই হবে৤  এত সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ নেই৤ যেদিন করূণাঘন বুদ্ধ সম্যক সম্বুদ্ধত্ব জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে কর্মবীজ সম্পূর্ণ ক্ষয় পূর্বক সোপদিশেষ নির্বাণে উন্নীত হলেন- তাঁর সেদিনের কম্বুকন্ঠের উচ্চারণ ছিল নিম্নরূপঃ

”অনেক জাতি সংসারং সন্ধা বিসসং অনিব্বিসং,

গহকারকং গবেসন্তো দুক্‌খা জাতি পুনপ্‌পুনং

গহকারং দিটেঠাসি পুন গেহং না কাহসি

সব্বাতে ফাসুকা ভগ্‌গা, গহকুটং বিসংকিতং

বিসাংখার গতং চিত্তং তণ্‌হানং খয়মজ্‌ঝগা৤”

অনুবাদঃ

জন্ম-জন্মান্তর পথে ফিরিয়াছি পাইনি সন্ধান

সে কোথা গোপনে আছে, এ গৃহ যে করেছে নির্মাণ৤

পুনঃপুনঃ দুঃখ পেয়ে দেখা তব পেয়েছি এবার,

হে গৃহকারক! গৃহ না পারিবে রচিবারে আর৤

ভেঙ্গেছে তোমার স্তম্ভ চুরমার গৃহ ভিত্তিচয়,

সংস্কার বিগত চিত্ত তৃষ্ণা আজি পাইয়াছে ক্ষয়৤

(সত্যেন্দ্র নাথ ঠাকুর)

করুণাঘন বুদ্ধ কর্মচক্র, ভবচক্র, তথা ব্যূহচক্রের উর্ধ্বে অধিষ্ঠিত হলেন৤ জন্ম-মৃত্যুর উর্ধ্বে উঠলেন৤ একত্রিশ লোক ভূমির মারভূবন অতিক্রম করে সমস্ত দুঃখ অন্তসাধনের পথ আবিষ্কার করলেন৤ আবিষ্কার করলেন চতুর্মহাসত্য৤ যে কর্মচক্র, ভবচক্র, সংসারচক্র বা ব্যূহচক্র আমাদেরকে অনাদি অনন্তকাল থেকে এ একত্রিশ লোকভূমির আবর্তনের মধ্যে ধরে রেখেছে তার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ চতুর্রাযসত্য The
Four Noble Truth. বুদ্ধের আবিষ্কৃত- এ মহাসত্যের শ্বাশত বা চিরন্তন উচ্চারণ হচ্ছে- জগৎ দুঃখময়৤ জীব জগত জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মরণ দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ ও প্রিয় বিয়োগ দুঃখ, যা ইস্পিত প্রার্থিত তা না পাওয়ার দুঃখের অধীন৤ তাঁর সত্য দৃষ্টিতে ‘পঞ্চস্কন্ধ’ লাভ করাটাই পরম দুঃখময়৤ এ দুঃখ আবার প্রতিনিয়ত ইদয় ও বিলয় ধর্মী তথা অনিত্য৤ যা অনিত্য তা দুঃখময় ও অনাত্না৤ এ দুঃখকে সম্পূর্ণ নিরোধ করা সম্ভব৤ এবং এ ভবচক্রের বা কর্মচক্রের বা সংসার চক্রের তথা ব্যূহচক্রের আবর্তিত বিবর্তিত যাবতীয় দুঃখের সম্পূর্ণ বিলয় সাধনের পথ তিনি আবিষ্কার করলেন- যা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গরূপে- আমাদের বৌদ্ধদের মাঝে দুঃখ মুক্তির চিরন্তন মহাসত্যরূপে দেদীপ্যমান৤

জীবের জাগতিক যাবতীয় দুঃখ অতিক্রমণের যে পথ তা আটটি Faculty তে বা কর্মশক্তিতে বিভক্ত৤ এ আটটি Faculty হল নিম্নরূপঃ-

প্রজ্ঞা

১৤ সম্যক দৃষ্টি

২৤ সম্যক সংকল্প

শীল

৩৤ সম্যক বাক্য

৪৤ সম্যক কর্ম

৫৤ সম্যক জীবিকা

সমাধি

৬৤ সম্যক উদ্যম

৭৤ সম্যক স্মৃতি ও

৮৤ সম্যক সমাধি

দুঃখ মুক্তির উপায় আর্যসত্যরূপে যে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা Faculty ‘র বা কর্মদক্ষতা সমূহের তালিকা উপরে বিধৃত করা গেল- তারা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত৤ একটির অবর্তমানে অপরটি উৎপন্ন হওয়ার বা অর্জিত হওয়ার কোন অবকাশ নেই৤ তারা শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার সমলংকৃত সমন্বিত সমাহার৤ সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম ও সম্যক জীবিকা শীল বা Morality‘র অন্তর্ভুক্ত৤

সম্যক উদ্যম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি- সমাধির অন্তর্ভুক্ত৤ আর সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সংকল্প প্রজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত৤ অতএত, শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা সর্ব দুঃখ অন্তঃসাধনের তিনটি Faculty’ বা কর্মশক্তি- যা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত বা অবিচ্ছেদ্য৤ শীলের অবর্তমানে সমাধির কথা চিন্তা করা বাতুলতা মাত্র৤ আর সমাধি ব্যতীত প্রজ্ঞার উৎকর্ষ বিধান একেবারে অসম্ভব, অনেকটা দিবা স্বপ্নের মতো৤

মোর্দ্দাকথায় ব্যূহচক্র মানে সংসার চক্র৤ এ সংসার চক্রকে আমরা কর্মচক্র অথবা ভবচক্র হিসেবেও অভিহিত করতে পারি৤ এখানে করুণাঘন বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শনে সংসার চক্রের অপর নাম দ্বাদশ নিদান- যা আমাদের জীব জগতকে এ ভব সংসারে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে৤ ইংরেজিতে এ দ্বাদশ নিদানকে বলা হয় Law of Causation. একে সংক্ষিপ্তভাবে প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি নামেও অভিহিত করা যায়৤ এখানে বিধৃত রয়েছে- ‘ইমস্মিং সতি ইদং হোতি’ ইমস্‌স ইপ্‌পাদা ইদং উপজ্জতি৤’ বিপরীতে বা প্রতিলোমে “ইমস্মিং অসতি ইদং ন হোতি, ইমস্‌স নিরোধা ইদং নিরুজ্জন্তি৤” এক কথায়- “হেতুর উৎপত্তিতে ফলের উৎপত্তি, হেতুর নিরোধে ফলের নিরোধ৤”

ব্যূহচক্র বা কর্মচক্র বা ভবচক্র বা সংসার চক্রের আবর্তিত বিবর্তিত পরিণতি সম্পর্কে জীবন ঘনিষ্ট সম্যক দর্শনের সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি বা কার্যকারণ নীতি অনুলোম ও প্রতিলোম উল্লেখ করে নিম্নে প্রদান করা গেল-

প্রতীত্য সমুৎপাদ (অনুলোম)ঃ “ইমস্মিং সতি ইদং হোতি, ইমস্‌স উপ্‌পাদা ইদং উপজ্জতি, যদিদং অবিজ্জা পচ্চয়া সঙ্খারা পচ্চয়া বিঞ্‌ঞানং, বিঞ্ঞান পচ্চয়া নামরূপ, নামরূপ পচ্চয়া সলায়তনং, সলায়তন পচ্চয়া ফস্‌সো, ফস্‌সো পচ্চয়া বেদনা, বেদনা পচ্চয়া তণ্‌হা, তণহা পচ্চয়া উপাদানং, উপাদান পচ্চয়া ভব, ভব পচ্চয়া জাতি, জাতি পচ্চয়া জরা-মরণং- শোক -পরিদেব-দক্‌খ-দোমনস্‌সুপায়াসা সম্ভবন্তি: এবমেতস্‌স কেবলস্‌স দুক্‌খ কন্ধস্‌স সমুদয়ো হোতি৤”

প্রতীত্য সমুৎপাদ (প্রতিলোম)ঃ ইমস্মিং অসতি ইদং ন হোতি, ইমস্‌স নিরোধা ইদং নিরুজ্জন্তি, যদিদং অবিজ্জায়ত্বেব অসেস বিরাগ নিরোধা সঙ্খারানিরোধা, সঙ্খারা নিরোধা বিঞ্‌ঞানং নিরোধো, বিঞ্‌ঞান নিরোধা নামরূপ নিরোধো, নামরূপ নিরোধা সলায়তন নিরোধো, সলায়তন নিরোধা ফস্‌স নিরোধা ফস্‌স নিরোধা বেদনা নিরোধো, বেদনা নিরোধা তণ্‌হা নিরোধা উপদান নিরোধা ভব নিরোধো, ভব নিরোধা জাতি নিরোধো, জাতি নিরোধা-জড়া-মরনং-সোক-পরিদেব-দুক্‌খ-দোমনস্‌সুপায়াসা নিরুজ্জন্তি এব মে এব মেতস্‌স দুক্‌খকন্ধস্‌স নিরোধো।

এ প্রতীত্য সমুৎপাদ বা কার্যকারণ  নীতিকে বাংলায় অনুবাদ করে সাজালে এরূপ দাঁড়ায়ঃ

অবিদ্যার কারণে সংস্কার,

সংস্কারের কারণে বিজ্ঞান,

বিজ্ঞানের কারণে নামরূপ,

নামরূপের কারণে ষড়ায়তন,

ষড়ায়তনের কারণে স্পর্শ,

স্পর্শের কারণে বেদনা,

বেদনার কারণে তৃষ্ণা,

তৃষ্ণার কারণে উপদান,

উপদানের কারণে ভব,

ভবের কারনে জাতি বা জন্ম,

জাতির কারণে জরা, মরণ, শোক,

পরিবেদন, দুঃখ দৌর্মনস্য প্রভৃতির উৎপত্তি হয়।

অতএব, ব্যূহচক্রের ফাঁদে ভব বন্ধনে বেঁধে রাখার প্রথম তথা প্রধান Concept হল অবিদ্যা । ইংরেজিতে এর অর্থ Ignorance মানে
অজ্ঞতা। এই ‘অবিদ্যা’ জীবজগতকে দুঃখ সাগরে নিপতিত করার প্রথম ও প্রধান কারণ। এ অবিদ্যার কারণে আমরা প্রতিনিয়ত নানাবিধ কর্মের মধ্য দিয়ে সংস্কার উৎপন্ন করে চলেছি। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কারও বিজ্ঞান তথা এক কথায় নামরূপের মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যূহচক্রের ভব বন্ধনে জটটি বিজটিট হয়ে পড়েছি তা স্থুলচক্ষে বা চর্মচক্ষে দেখা এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ব্যতীত উপলব্ধি করা সত্যি কঠিন ও দুরানুবোধ্য। রূপ, বিজ্ঞান, সংজ্ঞা, বেদনা ও সংস্কার তথা নামরূপ কিভাবে Action ও Reaction  এর মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত নানাবিধ সংস্কার Generate করে যাচ্ছি  তার একটি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা নিম্নে প্রদান করা গেল-

রূপ-পঠবী ধাতু, তেজ ধাতু, বায়ু ধাতু অপ ধাতু ও অপ ধাতুর সমন্বয়ে গঠিত রূপ বা শরীর। বিজ্ঞান Cognition Part – অবধারিত
অংশ। সংজ্ঞা –
Recognition part – শনাক্তকরণ অংশ।

বেদনা – Feelings
Part – অনুভূকতর অংশ।

সংস্কার- Actin
part ও Recognition part. ক্রিয়া
বা প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংস্কারোৎপত্তির অংশ। নামরূপ নামক শরীরের কোন একটি অংশে একটি ঘটনা সংঘটিত জতে যাচ্ছে- তার প্রথম ভাগে অবধারণ অংশ সচকিত হবে, অতৎপর সনাক্তকরণ অংশ পেরিয়ে অনুভূতির অংশে গমনপূর্বক Actin বা
Reaction এর মধ্য দিইয়ে এর সমাপ্তি ঘটবে।

উদাহরণঃ শরীরের কোন একটি অংশে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে, জরিপ করে দেখা গেল-সেখানে একটি মশা বসে রয়েছে , যেখানে মশা বসে রয়েছে সেখানে ব্যাথাটা অনুভূত হচ্ছে, ব্যাথা থেকে মুক্তির জন্য মশাটিকে লক্ষ্য করে এক থাপ্পর বসানো হল-পরিণামে মশাটি মারা গেল অথবা কাজটি হয়ে গেল অথবা সংস্কার কায়িক Action এর মাধ্যমে সধিত হল। এভাবে প্রতিনিয়ত
Cognition Recognition, Feelings ও
Action এর মধ্য দিয়ে কায়িক, বাচনিক ও মানসিক এ ত্রিবিধ দ্বারে আমরা কর্ম সংস্কার Generate করে যাচ্ছি গোটা জীবন ধরে। এবং এখানেই অবিদ্যার পরিবর্তে বিদ্যা বা জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক গুরুত্ববহ বিবেচিত হয়। অজ্ঞতাই অবিদ্যা। অবিদ্যা বা অজ্ঞতা কি? রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান সম্বন্ধে তথা পঞ্চ উপাদান স্কন্ধ যে চরম দুঃখময় – তা না জানার অপ্র নামই অবিদ্যা। এ অবিদ্যার কারণে জীব জগতে অনাদি অনন্তকাল ধরে ভবচক্র বা কর্মচক্র বা সংসারচক্রের বা চক্রব্যূহের মধ্যে আবর্তিত বিবর্তিত অবস্থায় জীবজগৎ ঘূর্ণায়মান রয়েছে তার যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধির লক্ষ্যে আনন্দ বিহারে আজকের এ প্রতীকী ব্যূহচক্রমেলার অবতারণা বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

ব্যূহচক্রমেলার প্রয়োজনীয়তা কি? আজকের একবিংশ শতাব্দীতে কতটুকু গুরুত্ববহ?

আনন্দ বিহার প্রতিষ্ঠার বছর হল ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ। প্রতিষ্ঠার বছর থেকে এ বিহারের পবিত্র প্রাঙ্গণে এ ব্যূহচক্র মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে পরম বিশ্বস্ততায় এবং ঐকান্তিক শ্রদ্ধাভরে। এবারে ব্যূহচক্র মেলা আনন্দ বিহারের ৭৫ (পচাত্তর) তম ব্যূহচক্র মেলা। পূর্বে আনন্দ বিহারের ব্যূহচক্র মেলাকে ঘিরে রাঙ্গামাটির আপামর বৌদ্ধ জনতার অন্তরের টান, উন্মতাল ভালোবাসা ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ । কথিত আছে – বহু নান্দনিক ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক রাঙামাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির প্রাণশক্তিতে ভরপুর কোমল প্রাণ বৌদ্ধ ছাত্র ছাত্রীরা  প্রতিবছর এই ব্যূচক্রের যাবতীয় কাজ সুসম্পাদন করতেন। বনের বাঁশ কেটে বেড়া বানানো থেকে শুরু করে তা যথাযথ প্রতিস্থাপন, ব্যূহচক্র মেলা পরিচালনা, মাঘী পূর্ণিমার দিনে করুণাঘন বুদ্ধের পাদ মূলে পূজা নিবেদন, পবিত্র বোধি বৃক্ষের পাদমূলে পূজার্চনা, ব্যূহচক্রের অভ্যন্তরে সাময়িকভাবে প্রতিস্থাপিত বুদ্ধের পাদমূলে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে বুদ্ধ সংকীর্ত্নের মধ্যদিয়ে অতিব আড়ানবরপূর্ণভাবে
সারিবদ্ধ হয়ে পূজা নিবেদনের লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা ছিল সর্বতভাবে প্রাণময় পুত পবিত্র আঙ্গিকতায় ভরপুর।  কালের বিবর্তনে এক বিংশ শতাব্দীর অপ্রতিরোধ্য যুগযন্ত্রণায় অথবা সমন্বিত দিক নির্দেশনার অভাবে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সে সময়কার নবম শেণির কোমল প্রাণ বৌদ্ধ ছাত্র/ছাত্রীদের রাঙ্গামাটির আনন্দ বিহারে মাঘী পূর্ণিমার এ ব্যূহচক্র মেলার টান আজ স্পন্দিত আন্তরিকতায় প্রাণময় নয় মোটেই।

১৯৭৮ এর শুভ বৈশাখী পূর্ণিমার ২/৩ দিন আগে আমি এ ঐতিহ্যবাহী ‍সুপ্রাচীন আনন্দ বিহারে উপাধ্যক্ষ হিসেবে আগমন করি। আমাকে যারা এ বিহারে পরম মমতায় সাদরে বরণ করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা হলেন রাঙ্গামাটি মৈত্রী বিহরের তখনকার অধ্যক্ষ আমার অত্যান্ত শ্রদ্ধাভাজন প্রয়াত ভদন্ত বিমল বংশ মহাথের, আনন্দ বিহারের তখনকার সম্পাদক বাবু করুনেশ চাকমা ও এ বিহারের ্ও রাঙ্গামাটির তখনকার বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্ব আনন্দ বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি ডাঃ যামিনী রঞ্জন চাকমা মহোদয়। তারা আজ আমাদের মাঝে নেই। মহাকাল তাদেরকে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হরণ করে নিয়ে গেছে। আজকের এ পবিত্র মাঘী পূর্ণিমার দিনে ঐকান্তিক সশ্রদ্ধচিত্তে কামনা করি তাদের পারলৌকিক উত্তরোত্তর সদ্‌গতি ও কল্যাণ। জন্ম-জন্মান্তরের অমোঘ নিয়মে আবারও তারা ফিরে আসুক আমাদের এ পোড় খাওয়া সমাজে, সমাজের ধ্রুব জ্যোতিরূপে।

বস্তুতঃ ১৯৭৯ সাল থেকে দেখে আসছি পবিত্র মাঘী পূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে আনন্দ বিহারে পবিত্র প্রাঙ্গণে আনন্দ বিহারের কার্যনির্বাহ কমিটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরম মমতায় ও আন্তরিক বিশ্বস্ততায় ব্যূহচক্র মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে দু’একজন তথাকথিত সদ্ধর্ম সচেতন মানুষের মুখে উচ্চারিত হতে শোনা যায় – কি দরকার এত টাকা খরচ করে এ ব্যূহচক্র মেলা উদযাপন করার? এ মেলার দ্বারা জরাজীর্ণ বৌদ্ধ সমাজে  কি কোন কাঙ্খিত সমৃদ্ধি বা পরিবর্তন আসছে? অথবা এ মেলার প্রাণময় আবেদন নৈতিক অবক্ষয় তাড়িত বৌদ্ধদের মাঝে  নৈতিক
ভিত্তি সুদৃঢ় করে দিচ্ছে কি? এরূপ অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে বিনা দ্বিধায়। তদুত্তরে আমার জবাব হল এরূপঃ করুনাগণ বুদ্ধ তো তাঁকে আমিষ সহযোগে পূজা না করতে বলেছেন। নিরামিষ পূজাই হচ্ছে তার পাদমূলে নিবেদিত পূজার অর্ঘ্য। এখানে আমিষ পূজা হচ্ছে – ভাত, তরকারী, ফুল, পুষ্প, মালা, গন্ধদ্রব্যসহযোগে বিভিন্ন খাদ্য ভোজ্য লেহ্য পেয়দতির মাধ্যমে পূজা। আর নিরামিষ পূজা হচ্ছে – শীল, সমাধি ও প্রজ্জায় বিমন্ডিত হয়ে আলোকিত পুণ্য পুরুষরূপে তার নির্দেশিত সর্ব দুঃখান্ত সাধনের পথে পরিপূর্ণ আত্মনিবেদন। তবু বৌদ্ধ বিশ্বে নিরামিষ পূজার চাইতে আমিষ পূজার মাধ্যমে বুদ্ধের পাদমূলে পূজা নিবেদন করার রীতিকে বহাল রাখা হয়েছে পরম মমতায়।

বস্তুতঃ আমিষ পূজা এখানে মূল উপলক্ষ নয় বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এখানে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে শুভ সম্মিলনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক আবাল বৃদ্ধ বনিতার সমসমন্বিত সম্মিলন সহযোগে পরম ভক্তি বিনম্র চিত্তে করুণাগণ বুদ্ধের অপ্রমেয় গুণসমূহের স্মৃতিচারণ, পঞ্চশীলে অধিষ্ঠিত হওয়া, জ্ঞাতি সম্মিলন, পারষ্পরিক কুশল বিনিময়, পূণ্যদ্যোতক পুণ্য কর্ম সুসম্পাদনের লক্ষ্যে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, করুণাঘণ বুদ্ধের পাদমূলে ব্যক্তিক ও সমষ্টিগত অঙ্গিকার সমূহকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়ার লক্ষ্যেই আজকের এই আমিষ পূজার পূণ্যময় উপস্থিতি।

উল্লেখযোগ্য পূর্ণিমাসমূহে আমিষ সহযোগে পূজা উদযাপন অনেকটা আত্মশুদ্ধি, আত্মসমীক্ষা, আত্মোপলব্ধি, আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মদর্শনের একটি মনষ্কামনাজাত প্রচেষ্টা যা সম্যক উদ্যমের পরম পরাকাষ্ঠারূপেও মূল্যায়িত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এছাড়া সমন্বিত আমিষ পূজার বদৌলতে ভাবী প্রজন্মের মনোমন্দিরে বৌদ্ধ সংস্কৃতি, বৌদ্ধ ঐতিহ্যের গৌরবজ্জ্বল ও শ্রদ্ধাসহগত উত্তরাধিকারে প্রজন্মকে উত্তরাধিকারী করার প্রয়াসটি তো রয়েছেই। শুভ মাঘী পূর্ণিমার পবিত্র তিথি উপলক্ষ করে আনন্দ বিহারে চিরাচরিত ভাবে প্রতিবছর ব্যূহচক্র মেলা উদ্‌যাপন অনেকটা উপরোক্ত Faculty বা কর্মশক্তি সমূহকে সঞ্জীবিতকরার মহতী প্রয়াসেরই সার্থক কর্মদ্যোগ। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সবার মনে রাখা দরকার যে বুদ্ধের ধর্ম দর্শন বিত্ত প্রধান নয় চিত্ত প্রধান। এ ধর্ম কখনো লৌকিক সুখ সমৃদ্ধিকে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেনি। বুদ্ধের শাসন-সদ্ধর্ম তথা ধর্ম দর্শনকে এক কথাইয় বলা যেতে পারে চিত্ত প্রধান ধর্ম দর্শন। এ ধর্মের আত্যন্তিক উন্নতি মান চিত্তের বা মনের  উৎকর্ষ বিধান।

বস্তুতঃ কায়িক ও বাচনিক সৎ কর্মের মধ্য দিয়ে মানসিক তথা নৈতিক উৎকর্ষ বিধানের মাধ্যমে মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা সহগত চিত্ত সন্ততিকে সহায়ক শক্তি  হিসাবে
সম্মুকে রেখে এ পৃথিবীতে সর্বস্তরের সর্ব শ্রেণীর মানুষের বাসযোগ্য করে তোলাই হল বুদ্ধের ধর্ম দর্শনের কালজয়ী অঙ্গীকার। অতএব, রাঙ্গামাটিস্থ সর্বস্তরের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৈষয়িক উন্নতির সহায়ক শক্তির একটি Component হিসেবে
যদি ব্যূহচক্র মেলাকে গণ্য করে মূলায়িত করা হয় তাহলেই অদূর ভবিষ্যতে এ মেলার দীর্ঘ যুগের প্রাণময় আবেদন ও অঙ্গীকারের যে ধারা প্রবাহমান রয়েছে তা ব্যাহত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই, আমি কামনা করি রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারের এ বহু ঐতিহ্যমন্ডিত প্রজন্মের স্মৃতিসংবাহিকা মাঘী পূর্ণিমার এ ব্যূহচক্র মেলাকে আরও প্রাণবন্ত আরও সজীব, আরও প্রতিশ্রুতিশীল, আরও কালজয়ী করার লক্ষ্যে রাঙ্গামাটির সর্বস্তরের বৌদ্ধ জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ আরও জোরদার ও সুদূরপ্রসারী হোক । আনন্দের বিষয় যে, চিরাচরিত নিয়মে ব্যূহচক্রমেলা আনন্দ বিহারের দায়ক দায়িকাদের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রাজবিহার, মৈত্রী বিহারসহ অপরাপর বিহার সমূহের দায়ক-দায়িকাদের উদ্যোগে সার্বজনীনভাবে উদ্‌যাপিত হচ্ছে। এবারেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

ব্যূহচক্র মেলা কোন শ্রেণীর মেলা?

বর্তমান সময়ে শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে নানান জায়গায় বিভিন্ন শ্রেণীর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তন্মধ্যে সরকারী ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত ’বাণিজ্য মেলা’, ’কৃষি মেলা’, ’আনন্দ মেলা’, ’বৃক্ষ মেলা’, ’বই মেলা’ প্রভৃতি। কিন্তু মাঘী পূর্ণিমার পবিত্র দিনে রাঙ্গামাটির আনন্দ বিহার প্রাঙ্গনে যে মেলা অনুষ্ঠিত হয় সেটা হচ্ছে ব্যুহচক্র মেলা। এ ব্যূহচক্রমেলা কোনমতে উপরক্ত মেলাগুলোর সাথে তুলনীয় হতে পারে না। উপরোক্ত মেলাসমূহ বোইষয়িক সমৃদ্ধি তাড়িত মনষকামনার চুড়ান্ত পরিণতিকে সম্মুখে রেখে উদ্‌যাপিত হয়। কিন্তু ব্যুহচক্র মেলায় বৈষয়িক সমৃদ্ধির পরিবর্তে সংসার চক্র, ভব চক্র, কর্মচক্রে বা ব্যূহচক্রের আবর্ত-বিবর্তমান অবস্থা থেকে জীবজগতের মুক্তির মনষ্কামনাকেই সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। অতএব, আনন্দ বিহারের ব্যুহচক্র মেলাকে অপরাপর কামিনীকাঞ্চন গন্ধী মেলার সাথে একই কাতারে ফেলে বিচার বিবেচনা করলে সংসারাবর্ত থেকে মুক্তির প্রতিকী উদ্যগের প্রতি অসন্মান দেখানো হয় বলে আমার ধারণা।

বিগত ৭৫ (পচাঁত্তর) বছরে আনন্দ বিহারের ব্যূহচক্র মেলা রাঙ্গামাটিস্থ বৌদ্ধ জনগনের মনোমন্দিরে ভবচক্রের ব্যূহ বন্ধন থেকে মুক্তির কোন পথ দেখাতে পেরেছে কি?

বস্তুত: করুণাঘন বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন গম্ভীর, দূরনুবোধ্য, শান্ত , প্রণীত, তর্কাতীত, নিপুণ, প্রণিত বেদনীয় ও দুর্ধর্ষ। এ ধর্ম
সর্বতোভাবে বাস্তবানুগ। এ ধর্মকে যথাসময়ে পঠন, পাঠন বা গুরুমুখে শ্রবণের মধ্য দিয়ে তা অন্তরের অন্তস্থলে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করণ জরুরী। ধর্মকে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত রেখে যথোপযুক্তভাবে মনন ও প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে অনুশীলনের মাধ্যমে দান-শীল ও ভাবনাময় কর্মাদি অনুষঙ্গে শীল-সমাধি ও প্রজ্ঞার চরমোৎকর্ষ বিধান করে ভবচক্রের তথা সংসার চক্রের বন্ধন ছিন্ন করা দুর্লভ মনুষ্য জন্ম লাভকারী সকল মানুষেরই অবশ্য কর্তব্য। করুণাঘন বুদ্ধও তাই করেছিলেন। বুদ্ধ জাতকে বর্ণিত ৫৫০ জন্মের মধ্যে দশ পারমী, দশ পারমী, দশ উপপারমী ও দশ পরমার্থ পারমী পূর্ণ করে সিদ্ধার্থ জন্মে আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও আত্মোপলদ্ধির উপর ভিত্তি করে সম্যক সম্বুদ্ধত্ব জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আর্যসত্য আবিষ্কার করেছিলেন। দুঃখান্ত সাধনের জন্য আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গ নিদের্শ করেছিলেন। ক্ষীণবীজাবস্থায় কর্মচক্রের ব্যূহ বন্ধন ছিন্ন করে পরিনির্বাপিত হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, আমরা যাঁরা বর্তমানে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছি- হয়তো আমরা করুণাঘন বুদ্ধের মতো পরিপূর্ণ পারমী সম্ভার সাথে নিয়ে জন্ম পরিগ্রহ করিনি। তাই দান-শীল ও ভাবনাদি অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে পুণ্য পারমী সমূহ পুর্ণ করতে হবে। কায়, বাক্য ও মনে নিরন্তর দান-শীল ও ভাবনাময় কর্ম সম্পাদন করে ভবচক্রের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য সদা তৎপর থাকতে হবে।

অতএব, এ বিষয়টি সকলের মনে রাখা দরকার যে, ভবচক্রের, সংসারচক্রের, কর্মচক্রের ব্যূহবন্ধনের কর্মবীজ ক্ষয় করণ পূর্বক ক্ষীণবীজ হওয়া একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটি অনাদি অনন্তকালের সচেতন সাধনায় বিষয়। ধর্মপদে একটি গাথা রয়েছে:-

“মাপ্পমঞ্ঞেত পুঞ্ঞস্স ন মং তং আগামিস্সতি।
উদবিন্দু নিপাতেন উদকুম্ভোপি পূরেতি
ধীরো পূরতি পূঞ্ঞস্স থোক থোকম্পি আচিনং।” ১২২।

“এ পুণ্য আমার কাছে আসবে না- এরূপ মনে করে পুণ্যকে অবহেলা করো না। বিন্দু বিন্দু জল নিপতিত হতে হতে কলসী যেরূপ পরিপূর্ণ হয়, তদ্রুপ অল্প অল্প করে পুণ্য সঞ্চয় করতে করতেই পন্ডিত ব্যক্তিরা পুণ্যময় তথা পুণ্যপুত হয়ে ওঠেন। এখানে পুণ্যময় সত্ত্বা মানে আত্মশুদ্ধি, আত্মোপলদ্ধি ও আত্মসংযমতায় পরিপূর্ণ স্থিতধী একজন Enlightened one. সর্বগুণে গুণান্বিত আলোকিত মানুষ। এ আলোকিত মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া কিন্তু খুবই দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হয়-জন্ম জন্মান্তর ধরে কল্প কল্পান্তর পর্যন্ত। এ জন্মে আমাদের এটিই স্মরণ রাখা উচিত-প্রভূত পুণ্যবলে এ জন্মে আমরা মানুষ হিসেবে জন্মেছি। এ মনুষ্য জন্ম একটি সুদুর্লভ জন্ম। বুদ্ধের ভাষায়ঃ
“দুল্লভঞ্চ মনুস্সত্তং বুদ্ধপাদো চ দুল্লভো
দুল্লোভোচ ক্ষণ সম্পতি সদ্ধম্মো পরম দুল্লভো।”
১। সৌভাগ্যবশতঃ দুর্লভ মনুষ্য জন্ম লাভ করতে সক্ষম হয়েছি।
২। দুর্ভাগ্যবশতঃ এ জন্মে করুণাঘন বুদ্ধের চাক্ষুষ দর্শন আমরা পাই নি।
৩। সৌভাগ্যবশতঃ বুদ্ধের ধর্ম দর্শনের বদৌলতে ক্ষীণবীজ হওয়ার মত ক্ষণ সম্পত্তি আমরা পরিপূর্ণভাবে লাভ করেছি। অর্থাৎ ষড় ইন্দ্রিয়ের পরিপূর্ণতাসহ শীল, সমাধি প্রজ্ঞায় বিমন্ডিত হওয়ার মত শারীরিক সুস্থতা ও বর্তমান সময়ে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের যাবতীয়
Component সমূহ পৃথিবীর মধ্যে অদ্যাবধি বিদ্যমান রয়েছে।
৪। সৌভাগ্যবশতঃ শাসন-সদ্ধর্ম সুস্থিতি রয়েছে এ পৃথিবীতে। অর্থাৎ এখনো শাসন-সদ্ধর্মে শূন্যকল্প শুরু হয় নি।

করুণাঘন বুদ্ধকে চাক্ষুষ দেখা আমাদের দ্বারা সম্ভব না হলেও সৌভাগ্যবশতঃ যেহেতু আমরা পরিপূর্ণ সুস্থ সবল সদ্ধর্ম সচেতন মনুষ্য জন্ম লাভ করেছি, যেহেতু বুদ্ধের দুর্লভ শাসন ও সদ্ধর্ম অধ্যাবধি এ বিশ্বে দেদীপ্যমান সেহেতু কর্ম ও কর্মফলের প্রতি টঃ- গড়ংঃ বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা রেখে ভব বন্ধন ছিন্ন করার জন্য সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি?

ব্যূহচক্র আলোকে মানুষের কালজয়ী আবেদন কি হওয়া উচিত?
ব্যূহচক্র বা কর্মচক্র বা সংসারচক্র বা ভবচক্রের আলোকে মানুষের কালজয়ী আবেদন হওয়া উচিত সংসারচক্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন । যে সংসার চক্রের মধ্যে আমরা আবর্তিত ও বিবর্তিত অবস্থায় রয়েছি-তার স্বরূপ উদ্ঘাটন পূর্বক একত্রিশ লোক ভূমির উর্ধ্বে উঠা চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরই কাজ। করুণাঘন বুদ্ধের দৃষ্টিতে ‘দ্বিপদানঞ্চ চক্খুমা’ অর্থাৎ এ জীব জগতে যত প্রাণী আছে তন্মধ্যে দ্বিপদধারী যাঁরা তাদের মধ্য থেকে একমাত্র মানুষই চক্ষুষ্মান হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পারেন। করুণাঘন বুদ্ধের কম্ভুকন্ঠের উচ্চারণঃ
“মাগ্গাট্ঠঙ্গিকো সেট্ঠো সচ্চানং চতুরো পদা।
বিরাগো সেট্ঠো ধম্মানং দ্বিপদানঞ্চ চক্খুমা।”

-সকল মার্গের মধ্যে বা পথের মধ্যে অষ্টাঙ্গিক মার্গই শ্রেষ্ঠ। মার্গ বা পথ সত্য সমূহের মধ্যে মধ্যে চতুরার্য সত্যই শ্রেষ্ঠ সত্য। ধর্মের মধ্যে বৈরাগ্যই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আর দ্বিপদধারী মানুষের মধ্যে একমাত্র চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরাই শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হিসেবে বিবেচিত ও অধিষ্ঠিত হন।

চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরাই ভব বন্ধন ছিন্ন করার ক্ষমতা অর্জন করেন এবং এ মনুষ্য লোকেই তা সম্ভব। কারণ, একমাত্র মনুষ্য লোকেই সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ, যশ-অযশ ও নিন্দা-প্রশংসা তথা অষ্টলোকধর্মের কাঙ্কিত-অনাকাঙ্কিত পরিণতি রয়েছে পরিপূর্ণভাবে। ব্রহ্মলোক, মনুষ্যলোক ও স্বর্গলোক অষ্টলোক ধর্মের কাঙ্কিত ও অনাকাঙ্কিত পরিণতি নির্ভর নয়। আর তির্যক, প্রেত, অসুর ও নিরয় লোকও তাই। একমাত্র মুনুষ্যলোকেই অর্থাৎ মনুষ্য জন্মই পারে অষ্টলোকধর্মের উর্ধ্বে উঠে শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞায় বিমন্ডিত হয়ে সংসার চক্রের ভব বন্ধন ছিন্ন করার মতো অপ্রমেয় শক্তি অর্জন করতে। তাই এক কথায় বলা হয়েছে- “দুল্লভঞ্চ মনুস্সত্তং । অর্থাৎ মনুষ্য জন্ম দুর্লভ, যা সহজে লাভ করা যায় না। করুণঘন বুদ্ধের কালজয়ী উচ্চারণঃ
‘পঞ্চছিন্দে পঞ্চজহে পঞ্চ চুত্তরি ভাবয়ে।
পঞ্চ সঙ্গাতিগো ভিক্খু ওঘতিন্নো’তি বুচ্চতি”
অনুবাদঃ
“পাঁচটিকে ছেদন কর, পাঁচটি পরিত্যাগ কর, আর পাঁচটির ভাবনা কর।”
-যে ভিক্ষু পাঁচের বন্ধন কাটিয়েছেন তাঁকে বলা হয় ওঘোতীর্ণ।”
এখানে “ওঘো” শব্দের অর্থ হল-সংসার সমুদ্র বা সংসার চক্র বা কর্ম চক্র বা ভব চক্র। কর্মচক্রের ভব বন্ধনে সঞ্চারমান জীবের অনিবার্য পরিণতিকে বলা যেতে পারে ওঘো বা সংসার সমুদ্র। এ ওঘো থেকে মুক্তির জন্য করুণাঘন বুদ্ধ ইহলোকের পঞ্চ বন্ধন:- সৎকায়দৃষ্টি, বিচিকিৎসা, শীলব্রত পরামর্শ, কামরাগ ও প্রতিঘ ছেদন করতে বলেছেন। পরলোকের পঞ্চবন্ধন”-রূপরাগ, অরূপরাগ, মান ঔদ্ধত্য ও অবিদ্যা পরিত্যাগ পূর্বক পঞ্চ গুণে গুণান্বিত হতে বিধান দিয়েছেন। এ পঞ্চগুণ হল-শ্রদ্ধা, স্মৃতি, বীর্য, সমাধি ও প্রজ্ঞা। এ পঞ্চগুণের জীবনঘনিষ্ট ও বাস্তবসম্মত ভাবনার মধ্যে দিয়ে পঞ্চদোষ এর বন্ধন কাটাতে বলেছেন। পঞ্চদোষদুষ্ট মানুষ সদাসর্বদা সংসার সমুদ্রে বা সংসারাবর্তে হাবুডুবু খেতে খেতে ব্যূহচক্রে ঘুরতেই থাকে। ঘুরতেই থাকে-অনাদি অনন্তকাল। জন্ম জন্মান্তর কাল। তারা কখনো “ওঘোতীর্ণ” হতে পারে না। এখানে ‘ওঘ’ বা সংসার সমুদ্রের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা হচ্ছে-কাম, ভব, দৃষ্টিও অবিদ্যা এই চার মনোবৃত্তি। ‘কাম’ মানে কামনা, ইন্দ্রিয়-সুখাভিলাষ, তৃষ্ণা, বিষয়ানুরাগ প্রভৃতি। ‘কাম’ আবার দুই ভাগে বিভক্তঃ বস্তুকাম ও ক্লেশকাম। রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ প্রভৃতি বস্তুকাম আর রাগ-দ্বেষাদি রিপুনিচয় হল-ক্লেশকাম। ‘ভব’ শব্দের অর্থ হল-কর্ম: উৎপত্তি ভব, জীবনের অস্তিত্ব। কামভব, রূপভব ও অরূভব। ‘দৃষ্টি’ মানে হল- মিথ্যাদৃষ্টি। আর অবিদ্যার অপর নাম তো অজ্ঞানতা বা ওমহড়ৎধহপব.
এক্ষণে আনন্দ বিহারের পবিত্র প্রাঙ্গণে পূত পবিত্র মাঘী পূর্ণিমার এ স্মরণীয় ও বরনীয় তিথিতে চক্রব্যূহ মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন কালজয়ী আবেদনে বিম-িত হতে পারে-যদি এ মহতী উদ্যোগ রাঙ্গামাটির তাবৎ বৌদ্ধদের মনোমন্দিরে ‘ওঘোতীর্ণ হওয়ার সুতীব্র বাসনা জাগাতে সক্ষম হয়।

বহু ঐতিহ্যমন্ডিত আনন্দ বিহারের ব্যূহচক্র মেলা রাঙ্গামাটি বৌদ্ধ সমাজঃ
করুণাঘন বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন আচার সর্বস্ব নয়। অনেকটা মন-মনন ও অনুশীলন নির্ভর ধর্ম-দর্শন। এ ধর্ম-দর্শনের মধ্যে বারো মাসে তেরো পার্বণের ঘনঘটা নেই। ধর্মীয় বিধি নিষেধ যতনা কড়াকড়ি ভাবে ভিক্ষু-শ্রামণেরদের জন্য রয়েছে, সাধারণ দায়ক দায়িকাদের জন্য পষ্ণ শীল পালনের নির্দেশনা ছাড়া তেমন ধরা-বাঁধা বিধি নিষেধ জল অচলভাবে নেই। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রত্যেক দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় ও শুক্রবারে মসজিদে বাধ্যতামূলকভাবে উপস্থিত থেকে ধর্মীয় বয়ান শ্রবণ অপরিহার্য। কিন্তু বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্মীয় ক্ষেত্রে সেরূপ সামাজিক জল অচল বিধি বিধান নেই। এতদ্কারণে, কোন কোন বৌদ্ধ দায়ক দায়িকার মুখে কোন কোন সময় শোনা যায়- মন্দিরে গিয়ে কি লাভ? আমার নিজের ঘরে বসেই তো আমি পঞ্চশীলে অধিষ্ঠিত হতে পারি। এর প্রতি উত্তরে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষে এটুকু বলার অবকাশ রাখি যে, পার্শ্ববর্তী স্কুলটিতে আমাদের ভবিষ্যত সন্তান সন্ততি বা প্রজন্মকে সাধারণ ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাদীক্ষার জন্য যেরূপ সতর্ক ও সচেতন দৃষ্টি আমরা পোষণ করে থাকি এ জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ নৈতিকতা শিক্ষার যে অপরিহার্য পীঠস্থান সেই বৌদ্ধ মন্দিরটিকে ও সমভাবে গুরুত্বারোপ পূর্বক মনুষ্যত্ববোধ উৎসর্জনের প্রাণ কেন্দ্রের মর্যাদা দিতে হবে। কারণ, সাধারণ শিক্ষাদীক্ষার মধ্য দিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধে ভাস্বর প্রজন্মই দেশে-বিদেশে তথা গোটা বিশ্বে দায়বদ্ধ দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালন এবং নিয়ম নিষ্ঠতার অনুষঙ্গে সকলের বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দিতে পারে। রাঙ্গামাটিস্থ আনন্দ বিহার এবং আনন্দ বিহারকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর মহাসাড়ম্বরে আয়োজিত ব্যুহচক্রমেলা প্রজন্মের কাছে কতটুকু নৈতিকতাবোধ উৎসর্জনের বাতাবরণ তৈরী করে দিতে পারছে- তা সময়ই বলে দেবে। তবে শ্রদ্ধাবান ও শ্রদ্ধাবতী দায়ক দায়িকাদের সমীপে এ বিষয়টি হৃদয় দিয়ে বিঘোষিত করার অবকাশ রাখি যে,
Ø শিশুরা অনুকরণ প্রিয়।
Ø স্বগৃহ হল শিশুদের প্রথম পাঠশালা।
Ø পিতা-মাতা সন্তান সন্ততির শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
Ø প্রজন্মের জন্য নৈতিক শিক্ষা সাধারণ বিদ্যা শিক্ষার চাইতে বেশী জরুরী।
Ø আপনি আচার ধর্ম পরকে শিখাও ।
Ø আত্মকেন্দ্রিক বা অহংসর্বস্ব মানসিকতা সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য।
Ø অহংকার নিজের পতন ডেকে আনে।
Ø পরচর্চা নয় আত্মচর্চাই আত্মোন্নতির চাবিকাঠি।
অতএব, ঘরে বসে পষ্ণশীলে অধিষ্ঠিত থেকে নিখুঁতভাবে শীল প্রতি-পালন সর্বতোভাবে সম্ভব হলেও সন্তান সন্ততির হাত ধরে যথাকালে যথাসময়ে পার্শ্ববর্তী মন্দিরে করুণাঘন বুদ্ধের পাদমূলে বসে প্রণাম নিবেদন, পূজা নিবেদন, ভিক্ষু-সংঘের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে এনে তাদের নৈতিক শিক্ষার অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচণ করে দেয়া একজন সচেতন, দূরদর্শী, দায়িত্ব সচেতন মাতাপিতারই কাজ। তবে একজন পিতা যদি সারাদিন সুরা সমুদ্রে ডুবে থাকেন, সন্তান-সন্ততির সম্মুখে পিতা-মাতা যদি হরহামেশা কলহবিবাদ, মারামারি ও পরস্পর গালি গালাজে লিপ্ত থাকেন, আত্মচর্চার পরিবর্তে পরচর্চা, পর-ছিদ্রাণে¦ষণ বা পরের দোষক্রুটি অন্বেষণে যদি তারা কালক্ষেপণ করেন তাহলে তাঁরা কিভাবে, কোন আশায়, কোন দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের বদৌলতে একজন পিতৃ-মাতৃভক্ত, ধর্মীয়ভাবে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান আলোকিত পুণ্যপুত সন্তান সন্ততি কামনা করেন? একজন দায়িত্ব সচেতন ও সদ্ধর্ম সচেতন ব্যক্তি তাঁর পুত্র-কন্যা অথবা পৌত্র, প্রপৌত্রদেরকে নিয়ে ধর্মীয়, সামাজিক, লোকায়ত অনুষ্ঠানসমূহে উপস্থিত থেকে ধর্মীয় ও লোকাচারসম্মত অতি আবশ্যিক দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ যদি সুসম্পাদন না করেন তাহলে তাঁর পক্ষে ভদ্র, শিষ্ঠ, নিয়মনিষ্ঠ, কর্তব্যনিষ্ঠ, সদ্ধর্মনিষ্ঠ, সুসন্তান, পৌত্র, অপৌত্র আশা করাটা দূরাশা নয় কি? এখানে করুণাঘন বুদ্ধের নির্দেশনা হচ্ছে-‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাও।’অতএব-
“Do all the good you can,

By all
the means you can,

In all
the ways you can,

At all
the place you can,

As
long as ever you can. “(J. Wesly)

নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ এক কথায় মনুষ্যত্বের মূল্যবোধ জাগ্রত করে দেয়ার মত কোন পীঠস্থান রাঙ্গামাটিতে আছে কি? যেখানে যথাকালে তথা রীতিমত ধর্ম শ্রবণ ও ধর্ম পর্যলোচনা করার ব্যবস্থা নেই-সেখানে ধর্মীয় ও মনুষ্যত্বের মূল্যবোধসম্পন্ন আলোকিত মানুষ আশা করা যায় কি? যেখানে মনুষ্যত্বের মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের অভাব সেখানে মুক্ত বুদ্ধি, মুক্ত চিন্তার অবকাশ আছে কি? যেখানে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্ত চিন্তার চর্চা হয় না সেখানে সত্যের আলোকে অলোকজ্জ্বল কোন শাশ্বত সুন্দরের আরাধনা করা যায় কি? এখানে সত্যের আলোকে আলোকজ্জ্বল শাশ্বত সুন্দর যদি কিছু থেকে থাকে-তাহলে তা-হল ভববন্ধন থেকে মুক্তির অপ্রমেয়. অদ্বিতীয় সত্য ‘চতুর্মহাআর্যসত্য’। এখানে আনন্দ বিহারের শুভ মাঘী পূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে প্রতীকী ব্যূহচক্র মেলা উদ্যাপনের মধ্যে দিয়ে জন্ম-মৃত্যুর অনন্ত অনন্ত রহস্যে ঘেরা একত্রিশ লোকভূমি থেকে মুক্ত হয়ে একজন Enlightened
one তথা আলোকিত মানুষরূপে অনন্ত ভববন্ধন ছিন্ন করার প্রয়াস চালানো হয়। প্রজন্মের ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী বিনির্মাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে আনন্দ বিহার পরিচালনা কমিটির গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপ শাশ্বত সত্যের আরাধনায় থাকুক বাগ্ময় ও উচ্চকিত। আসুন আমরা সকলে মিলে কবি সুকান্তের ভাষায় অঙ্গীকার করি-
চলে যাবো-তবু আজ যতক্ষণ
দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য
করে যাবো আমি’
নবজাতকের কাছে এ আমার
দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ ছেড়ে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাবো আশীর্বাদ,
তারপর হবো ইতিহাস।

সব্বে সত্ত্বা সুখীতা হোন্তু
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
সাধু! সাধু!! সাধু!!!

ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো
প্রধান অধ্যক্ষ
রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহার
তবলছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জিলা।

লেখক পরিচিতি

প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে একজন উচ্চ শিক্ষিত বৌদ্ধ ভিক্ষু। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৭৭ সালে বাংলা সাহিত্যে বি.এ (অনার্স) সহ এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৮০ সালে পালি সাহিত্যেও এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। তাঁর জন্মস্থান বর্তমান খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলার বাবু ছড়া গ্রামে। ১৯৫২ সালে এক চাকমা পরিবারে তাঁর জন্ম।
১৯৬৫ সালে তৎকালীন বোয়ালখালি দশবল বৌদ্ধ রাজ বিহারের অধ্যক্ষ পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সদ্ধর্মাদিত্য উপসংঘরাজ জ্ঞানশ্রী মহাথেরোর নিকট শ্রামন্যমর্ধে দীক্ষিত হন। ১৯৬৮ সালে এস.এস.সি পাশের পর বুদ্ধ পূর্ণিমাতে অষ্টমী তিথিতে একই গুরুর উপাধ্যায়াত্বে ২৬ জন প্রথিতযশা মহাথেরগণের উপস্থিতিতে উপসম্পাদা গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমের সাধারণ সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত হন তিনি। একইভাবে ১৯৭৬ সালে গ্রহণ করেন মোনঘরের সাধারণ সম্পাদকের পদ। ১৯৭৮ সালে এম.এ. পাশের পর তিনি আনন্দ বিহার, তবলছড়ি, রাঙ্গামাটিতে উপ-অধ্যক্ষ হিসেবে আগমণ করেন এবং উ-জবনাতিষ্য মহাথেরর মহাপ্রয়াণের পর তিনি আনন্দ বিহারের অধ্যক্ষ পদে অভিষিক্ত হন।

২০০৪ সালে ঢাকার মিরপুরে আদিবাসী গ্রিনহার্ট স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশ সংস্কৃত পালি শিক্ষা বোর্ডের অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। তিনি একজন সু-বক্তা এবং বিশিষ্ট ধর্মীয় গুরু হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করছেন। পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ অত্তদীপ ফউন্ডেশন-এর প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করছেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।